গত এক বৎসরে কত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হইয়াছে সেই পরিসংখ্যান সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে নাই। শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব দূরীকরণে লক্ষণীয় অগ্রগতিও নাই। গত এক বৎসরে জনশক্তি রপ্তানিও কমিয়াছে। দেশে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি নিয়া হালনাগাদ তথ্য না থাকিলেও সম্প্রতি সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের এক গবেষণা শিক্ষিত শ্রেণির বেকারত্ব নিয়া একটি ধারণা দিয়াছে। শনিবার (১১ জানুয়ারি) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, গত মাসে উপস্থাপিত ওই গবেষণায় দেখা যায়, কমপক্ষে মাধ্যমিক পাস, এমন শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের তিন ভাগের এক ভাগ বেকার। তাহারা কোনো কাজ করেন না বা পড়ালেখাও করেন না। শিক্ষিতদের মধ্যে সার্বিকভাবে ৪৮ শতাংশ পূর্ণকালীন কাজ করেন। ১৮ শতাংশের মতো খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। আর ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ সম্পূর্ণ বেকার। সবচাইতে বেশি বেকার স্নাতক ডিগ্রিধারীরা, প্রায় ৩৭ শতাংশ। আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়া ৩৪ শতাংশের বেশি বেকার। বিআইডিএসের এই গবেষণায় দেশে মাধ্যমিক হইতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের বেকারত্বের যে চিত্র উঠিয়া আসিয়াছে তাহাতে আমরা উদ্বিগ্ন না হইয়া পারি না। কেবল বিআইডিএস বা বিবিএসের জরিপ নহে, দেশি-বিদেশি প্রায় সকল জরিপ ও পরিসংখ্যানেই বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের তথ্য-উপাত্ত উঠিয়া আসিয়াছে। এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮ শীর্ষক প্রতিবেদনে ২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলের ২৮টি দেশের বেকারত্ব, তরুণদের কর্মসংস্থান, নিষ্ক্রিয় তরুণের হার, আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান, কর্মসন্তুষ্টি ইত্যাদির তুলনামূলক চিত্র পাওয়া গিয়াছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ২০১০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ হইয়া ২০১৭ সালে ১২ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়াইয়াছে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যাহা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দুশ্চিন্তার বিষয়, আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়িতেছে কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়িতেছে না। বিগত এক দশক ধরিয়া আমাদের জিডিপি ৬ শতাংশের উপরে এবং বিগত তিন-চার বৎসরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের উপরে উন্নীত হইলেও কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হইয়া পড়িয়াছে। উপরন্তু, উচ্চশিক্ষা এখন আর কাজ পাইবার নিশ্চয়তা দিতে পারিতেছে না। তরুণরা যত বেশি পড়ালেখা করিতেছেন, তাহাদের বেকার থাকিবার ঝুঁকি ততই বাড়িতেছে। দেশে শিক্ষার হার বাড়িয়াছে, কিন্তু সেই আনন্দ মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলায় যখন আমরা তাহাদের বড়ো একটি অংশকে কাজে লাগাইতেই পারি না। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দুই কারণে কর্মসংস্থান পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হইতেছে না। প্রধান কারণ, বৎসরে যত মানুষ শ্রমবাজারে যুক্ত হইতেছে তত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হইতেছে না। আবার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হইলেও তাহার বিপরীতে দক্ষ কর্মী নাই। শিক্ষার নিম্নমানের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীরাও দক্ষ নন। তাহারা চাকরি পাইলেও পছন্দমতো কাজ পাইতেছেন না।
দেশে বেকারত্বের ভয়াবহতা জানিতে কোনো জরিপের প্রয়োজন নাই। বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস কিংবা অন্য কোনো খাতে একটি শূন্য পদে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা দেখিলেই অনুমান করা যায়। বিশ্বের নামকরা অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে দেখিতেছেন কর্মসংস্থানের অভাবকে। এই অবস্থা হইতে পরিত্রাণের জন্য বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢালিয়া সাজাইবার দিকে মনোযোগী হইতে হইবে। শিক্ষাকে কাজে লাগাইতে হইলে প্রত্যেক নাগরিককে যেমন দক্ষ জনশক্তি হিসাবে গড়িয়া তুলিতে হইবে, তেমনি তাহাদের উপযুক্ত কাজের সংস্থানও করিতে হবে।