নেতৃত্বের ব্যাকরণ - দৈনিকশিক্ষা

নেতৃত্বের ব্যাকরণ

মোস্তাফিজুর রহমান শামীম |

আমরা সুযোগ পেলেই সবাই নেতা হতে চাই। বুদ্ধির ভাঁড় হতে চাই। না বুঝেই অনড় থাকতে চাই নিজের যুক্তিতে। আর এসব করি নিজেকে নিজেই নেতা মনে করার জন্য। অথচ এসব করা মানে অন্যের কাছে নেতা হওয়ার বৃথা চেষ্টা মাত্র। আবার শিখিয়ে পড়িয়ে কিংবা কোর্স করেও নেতা হওয়ার সুযোগ নেই। 

নেতা ও নেতৃত্ব আসলে কী? কোনো কাজ সম্পাদন অথবা লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আচরণকে প্রভাবিত করতে এক ধরনের বিশেষ দক্ষতা বা গুণ থাকা আবশ্যক। সে দক্ষতাকেই মূলত নেতৃত্ব বলা যেতে পারে। নেতা থেকে নেতৃত্বের আবির্ভাব। একজন শিক্ষকের মধ্যেও এমন দক্ষতা থাকা আবশ্যক।

আমাদের সমাজে নেতার অভাব নেই। রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক নেতা, শ্রমিক নেতা, ছাত্র নেতা ছাড়াও অনেক প্রকার নেতা রয়েছে। একটি পরিবারের যিনি কর্তা, তাকেও নেতা বলা যেতে পারে। 

নেতৃত্ব প্রদানের সক্ষমতা ও দক্ষতা যেসব নেতার মধ্যে বিদ্যমান, তারাই যোগ্য নেতা হিসেবে পরিচিতি পায়। আভিধানিক অর্থে নেতৃত্ব দ্বারা ব্যক্তির অগ্রসর কিংবা অগ্রে অবস্থানের ব্যক্তিকেই বোঝানো হয়। প্রকৃত অর্থে নেতৃত্ব কোনো ব্যক্তি নয় বরং এটি একটি প্রক্রিয়া মাত্র। জন সি ম্যাক্সওয়েলের একটি কথা আছে। তা হলো- ‘একজন নেতাকে অবশ্যই মানুষের কাছাকাছি যেতে হবে। তবে তাদের অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে যেতে হবে বহুদূর।’ 

নেতৃত্ব তৈরি একদিনে হয় না। ইতিহাস তাই বলে। এটা এক ধরনের সাধনা। নেতৃত্বের জন্য প্রথমত দরকার ত্যাগ। অন্যের ভালোর জন্য নিজের সময়, শ্রম ইত্যাদি দান করা। অন্যের সমস্যাকে নিজের মতো করে ভাবাটাও নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ক্যারিশমাটিক একজন নেতা। যার বজ্রকন্ঠের ডাক শুনে এদেশের মানুষ নির্দ্বিধায় ছুটে গিয়েছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, নিজেদের দাবী আদায়ের উদ্দেশ্যে। নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদ প্রথা বাতিল করে একটি দেশে সাদা-কালো একসাথে থাকার সম অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়েছেন কারাগারে। 

মাথায় প্রচুর বুদ্ধি থাকলেই যে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করা যায়, এই ধারণাও ভুল। শেয়ালের মাথায়ও প্রচুর বুদ্ধি, কিন্তু শেয়াল কখনও বনের মধ্যে নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা অর্জন করেনি। 

কীভাবে বুঝবেন আপনি নেতা হিসেবে অযোগ্য? ধরুন, আপনার কমিউনিটির কেউ আপনার কথা শুনছে না। অথবা আপনার কথা না শুনলেই নয়, তাই বাধ্য হয়ে শুনছে। আপনার প্রাপ্য সম্মান নিজের মুখে অন্যের কাছ থেকে চেয়ে নিতে হচ্ছে। আপনি কোথাও গেলে সাথে শেয়ালের মতো দুই একটি প্রাণী ছাড়া কাউকে পাচ্ছেন না। কর্মীদের অনুরোধ করে আপনার সম্মুখে বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। শত চেষ্টা করেও কর্মীদের মাথা থেকে ইনোভেটিভ আইডিয়া বের করতে পারছেন না। তখন আপনার মনের মধ্যে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক হবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি যদি নিজেকে সেই কর্মীর অবস্থানে চিন্তা করেন তাহলে সব উত্তর পেয়ে যাবেন। যদিও আপনার আসনে বসে এই চিন্তা করা খুব কঠিন কাজ। কারণ আপনি সবসময় সুপিরিয়র কমপ্লেক্সিটিতে  ভুগছেন। এটা এক ধরনের মানসিক রোগ। যোগ্য নেতৃত্বের প্রধান প্রতিবন্ধকতা সুপিরিয়র কমপ্লেক্সিটি।  

যোগ্য নেতৃত্বের মূলে রয়েছে নির্লোভ ও নিরহংকার হওয়া। শুরুতেই বলেছি, নেতৃত্ব কোনো ব্যক্তি নয়, এটি একটি প্রক্রিয়া মাত্র। এই প্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্য নেতাকে হতে হয় সহজ মানসিকতার। এর অর্থ এই নয় যে, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া। 
কোনটি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে হবে আর কোনটি নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে হবে, সেই দক্ষতা একজন নেতার রক্ত-মাংসের মধ্যে মিশে থাকতে হবে। আপনার কাজ আপনাকে অনেক কিছু দিতে পারে, যদি সে কাজে স্বচ্ছতা থাকে। আপনি নিজেকে বহুরূপী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। সেটাও এক ধরনের গুণ। যেই গুণটি মীরজাফরের মধ্যে ছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, একটা সময় আপনি আপনার বহুরূপের সমন্বয় সাধন করতে পারবেন না। কঠিন একটা বিক্রিয়া সৃষ্টি হবে আপনার বহুরূপী মানসিকতার মধ্যে। তখন মেন্টাল স্ট্রেস আলোর গতিতে বাড়তে থাকবে। মীরজাফরের মতোই পরিণতি হতে পারে। কেউ কেউ ইতিমধ্যে ভেবে বসেছেন আমি মীরজাফরকে সমর্থন করে কথা বলছি। না বুঝে শুনে এ ধরনের ভাবনা মাথায় নেয়াটাও বিশেষ কিছু মানুষের বিশেষ গুণ। যাই হোক তাদের ভেবে অহেতুক সময় নষ্ট করাটাও যথাযথ কাজ নয়। 

নিজের মধ্যে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করতে হলে সবার আগে ভাবতে হবে এই জীবনে আপনি কতজন শুভাকাঙ্ক্ষী তৈরি করতে পেরেছেন? আপনার দ্বারা সমাজ কতটুকু উপকৃত হচ্ছে? সামাজিক দায়বদ্ধতা আপনার মধ্যে আছে কি না? মানুষ চেনার সক্ষমতা আছে কি না? নিজের মধ্যে অমানুষ পুষে রাখলে অবশ্য এই জীবনে মানুষ চেনার আশা ছেড়ে দেয়াই ভালো। এসব প্রশ্ন যদি আপনার মাথায় আসার সুযোগ না পায়, তাহলে ধরে নেবেন আপনি একটা ঘোর বা বিভ্রমের মধ্যে আছেন। দিনে দিনে আপনার অবনতিই হচ্ছে। আপনার নেতৃত্ব দ্বারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারছেন না।

শিক্ষকতা পেশাতেও লিডারশিপ স্কিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমরা অনেকেই ঘরের কোণায় মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে লিডারশিপ দেখাই, নেতিবাচক মন্তব্য করি। এই মন্তব্য আবার অনেকেই খায়। তবে যারা খায়, তারাও ঘরের কোণায় বসেই খায়। সম্মুখে কোনো মন্তব্য করার সক্ষমতা তাদের কোনোদিন হয়নি, হবেও না। এই ভার্চুয়াল তৃপ্তি আমাদের বিবেক গিলে খাচ্ছে দিনের পর দিন। ক্রমাগত বাড়ছে আবেগের আনাড়িপনা। কিন্তু দিনশেষে আমরা সবাই মানুষ। তাই নিজের আবেগ দিয়ে বিবেক না খেয়ে, একটু যদি ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিই, তা হবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইতিবাচক। আত্ম-অধ্যয়ন একটি বিশেষ গুণ। যা আমাদের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে। আর এভাবেই গড়ে উঠতে পারে সুস্থ ধারার নেতৃত্ব। 

লেখক : সহকারী অধ্যাপক (ইংরেজি) ভেড়ামারা সরকারি কলেজ 

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032351016998291