প্রধান শিক্ষকের দাঁত! - দৈনিকশিক্ষা

প্রধান শিক্ষকের দাঁত!

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছে। নবী সোলাইমান বাদশাহের আংটি, আলাদিনের চেরাগ, সিন্দাবাদের সিন্দুক, মুঘলদের তখত, ময়ূর সিংহাসন, কোহিনূর হীরা, রাজা-বাদশাহের শান-শওকত, ক্ষমতা, দম্ভ ইত্যাদি বহু কিছু হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ।

কিছু কিছু বিষয় হারিয়েছে সময়ের বিবর্তনে। কিছু রাজনৈতিক ইতিহাসের চাকার ঘর্ষণে। কিছু আন্দোলনে আর কিছু নিজের অপকর্মের কারণে। সব কিছুকে ছাপিয়ে অদ্ভুত ঘটনা ও আত্মসাতের ধারাতেও বহু কিছু হারাচ্ছে। যেমন, বাংলাদেশে হারিয়েছে নদী, জলাশয়, টিলা, পাহাড়, বনাঞ্চল।

হরিলুটের স্রোতে হারিয়েছে অঢেল জাতীয় ও ব্যক্তিগত সম্পদ। অনলাইন-ডিজিটাল ফেরেববাজিতে হারিয়েছে আমজনতার হাজার কোটি টাকা। আর হাল আমলে হারিয়েছে ইজ্জতের প্রতীক শিক্ষার্থীদের চুল এবং সর্বশেষে প্রধান শিক্ষকের দাঁত!

ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, বগুড়ার নন্দীগ্রামে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির ঘুষিতে প্রধান শিক্ষকের তিনটি দাঁত পড়ে গেছে। সেদিন ছিল শুক্রবার (৮ অক্টোবর), তথা পবিত্র দিন। অথচ ঐদিনই ঘটলো অপবিত্র, নির্মম ও মর্মন্তুদ ঘটনাটি।

দাঁত-হারা আহত প্রধান শিক্ষকের নাম সাজ্জাদুল ইসলাম দুদু(৫৫), তাঁকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নন্দীগ্রাম উপজেলার পন্ডিত পুকুর বাজারে তাঁর মুখে ঘুষি দিলে তিনটি দাঁত পড়ে যায়। তিনি একই উপজেলার ভর-তেতুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। আর তাঁর দাঁত নির্মূলকারী স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি!

স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের কোনও না কোনও বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল, এটা স্পষ্ট। একসাথে কাজ করলে এমন হতেই পারে। সবাই সব বিষয়ে একমত হবেন, এমনও নয়। কিন্তু সম্পর্ক ভাল না হলে কিংবা মতপার্থক্য থাকলে সৌজন্য হারাতে হবে বা দন্ত উৎপাটন করতে হবে, এমন সংস্কৃতি কোথা থেকে এলো?

একইভাবে, শিক্ষার্থীরা কোনও অন্যায় করতেই পারে। সেজন্য বিচারের ও শাসনের বিধিবদ্ধ পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু বিচারের বা শাসনের বা সংশোধনের নামে তুঘলকি কায়দায় তাদের চুল কর্তন করে দেওয়ার আদৌ কোনও হেতু থাকতে পারে না। এহেন পদক্ষেপ আপত্তিকর এবং হিংস্রতা ও মানসিক বিকৃতির নামান্তর। 

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন চরম, আক্রমণাত্মক ও নিন্দনীয় পদক্ষেপের নজির চারদিকে বাড়ছে কেন? সমাজ কাঠামোয়, রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, সাংস্কৃতিক বিন্যাসে প্রায়ই উগ্র ও অসৌজন্যমূলক আচরণের পেছনে অন্তর্নিহিত কারণগুলোর মূল শেকড় কোথায় লুক্কায়িত রয়েছে? কেন নীতি, নৈতিকতা, আইনানুগ পন্থা ইত্যাদি বার বার বিপর্যস্ত হচ্ছে? দখল, দাপট, হামলা, আঘাত, দম্ভ ও সহিংসতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে? কেন মানুষ ও সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধ?

শিক্ষার্থীর চুল ও প্রধান শিক্ষকের দাঁত বিষয়ক অপকর্ম ঘটেছে শিক্ষাঙ্গনে। কিন্তু শিক্ষাঙ্গন তো কোনও বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। পুরো সমাজেরই অংশ। ফলে সমস্যার বীজ খুঁজতে হবে বৃহত্তর পরিসরে। এমন হিংসাশ্রয়ী ও কঠোর সমাজের কিছু বৈশিষ্ট্য সামাজিক গবেষণায় ধরা পড়েছে। যেমন, আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মনস্তত্ত্বের অধ্যাপিকা মিশেল গেলফান্ড নানা দেশের সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সমীক্ষা চালিয়ে ‘টাইট’ (আঁটোসাঁটো) আর ‘লুজ়’ (ঢিলেঢালা)-এ বিভক্ত করেছেন দেশগুলোকে।

গেলফান্ড এবং তাঁর সতীর্থরা বিশ্বাস করেন, কোন্ দেশের সমাজ কত আঁটোসাঁটো বা ঢিলেঢালা, তা অনেক কিছুর উপর প্রভাব ফেলে। দেশের মানুষ কতটা সৃষ্টিশীল, দেশে স্বামী-স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদের হার কী রকম, মত প্রকাশের ও ব্যক্তি স্বাধীনতা কতটুকু, এসব বিষয়ের হ্রাস-বৃদ্ধিও ঘটে দেশের চরিত্রের ভিত্তিতে, যার প্রভাব সমাজে ও মানুষের মধ্যে দেখা যায়।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেমন এবং কেন তা ক্রমাবনতিশীল, সেটা খতিয়ে দেখা জরুরি। উচ্চ থেকে নীচ পর্যন্ত হুঙ্কার, দম্ভ, ত্রাসের বীভৎসতা এখানে কোনও লুকানো বিষয় নয়। চারদিকে তাকালে সেই অস্বাস্থ্যকর ও অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি হামেশাই দেখা যাচ্ছে, যা কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের চুল ও প্রধান শিক্ষকের দাঁতে সীমাবদ্ধ নেই।

প্রধান শিক্ষকের উৎপাটিত দাঁত একটি প্রতীক ও সামান্য দৃষ্টান্ত মাত্র। বাস্তবে আরও কত কিছু উৎপাটিত হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে, তার হিসাব কে নেবে? যদি সেই হিসাব না নেওয়া হয় বা নেওয়া না যায়, তাহলে পরিস্থিতি কেবল নাজুক ও অসহনীয়ই হবে না, বরং দাঁতহীন হাসি মানুষ ও সমাজের প্রতি বিদ্রূপ করতেই থাকবে।

সূত্র : মানবজমিন

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.02648401260376