প্রশ্ন ফাঁস এবং আমরা - দৈনিকশিক্ষা

প্রশ্ন ফাঁস এবং আমরা

ড. মো. সোহেল রহমান |

প্রশ্ন ফাঁসের সেই শুরুর সময় থেকে চিন্তা করলে, এখন কিন্তু আমাদের অবস্থানের একটা অন্তত গুণগত পরিবর্তন হয়েছে—এখন আমরা অন্তত স্বীকার করে নিয়েছি যে প্রশ্ন ফাঁস বিষয়টি এক কঠোর বাস্তবতা! তবে সরকারিভাবে এর মধ্যেও একটা ঢাকঢাক-গুড়গুড় অবস্থা রাখা হয়েছে। জাফর ইকবাল স্যার তাঁর শেষ কলামে এ বিষয়ই একদম স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন।

বিষয়টি হলো, যদি সরকারিভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয় যে একটি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, তবে তো ওই পরীক্ষা বাতিল করতে হয়! সে তো এক বিশাল হাঙ্গামার ব্যাপার! সুতরাং তা করা হচ্ছে না। আমরা সবাই কমবেশি বুঝতে পারছি কী হচ্ছে; কিন্তু পরীক্ষাগুলো, তা-ও চলছে তাদের আপন গতিতে! আবার প্রথম দিকে যেমন প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে অনেক হৈচৈ হয়েছিল, এখন তা অনেক কমে গেছে। কেন এমন হলো? একটা কারণ সম্ভবত এই যে প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে বেশি কথা বললে ঝামেলা হতে পারে। যেমন আপনি যদি প্রশ্ন ফাঁসের গুজব ছড়ান, তাহলে শাস্তির বিধান করা হয়েছে। তো সেই ঝামেলা এড়ানোই তো ভালো!

প্রশ্ন ফাঁস রোধ করার জন্য বেশ কিছু পদ্ধতির কথা আলোচনায় এসেছে। যেমন কায়কোবাদ স্যার প্রথম থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপানোকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে পরীক্ষা শুরু হওয়ার অল্প সময় আগে প্রশ্ন ছাপানোর পরামর্শ দিয়ে আসছেন। এই একই রকম প্রস্তাব পরে আরো অনেকে দিয়েছেন। সম্প্রতি ঢাকা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে আমাদের বিভাগে এসংক্রান্ত আরো একটি সমাধানের কথা চিন্তা করা হয়, যেখানে একটি ইলেকট্রনিক সুরক্ষিত বাক্স ও খামের কথা চিন্তা করা হয়। এরই মধ্যে আমাদের বিভাগের দুটি দল দুটি আলাদা ডিজাইনের দুটি প্রটোটাইপ ডিজাইন করেছে এবং এগুলোর উন্নয়নে আরো কাজ করে চলেছে।

এ সমাধানগুলোর মূল বিষয়টি হলো এটি নিশ্চিত করা যে বাক্সটি বা খামটি শুধু আগেই বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ে ও শুধু অনুমোদিত কর্মকর্তাই বৈধভাবে খুলতে পারবেন; আর অবৈধভাবে খুলতে গেলেই সমস্যা হবে।
আগেই বলেছি, সরকারিভাবে প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ স্বীকার করা হচ্ছে না এই কারণে যে তাতে অবশ্যই পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। এর মানে হলো আমরা একটি হিসাব কষছি। হিসাবটা হলো এ রকম যে আমরা যদি প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারটা মেনে নিই, তাহলে আমাদের ক্ষতি বা ঝামেলা কতটুকু; আর আমরা যদি তা স্বীকার না করি, তাহলে কী হয়। এবং এই হিসাবে আমাদের মনে হচ্ছে যে প্রশ্ন ফাঁসটা অস্বীকার করাই শ্রেয়! কারণ অস্বীকার করে দেখা যাচ্ছে যে তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

জাতিগতভাবে আমাদের একটি বড় দোষ হলো আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খুব অদূরদর্শী। আমরা শুধু কাছের সমস্যাটা চিন্তা করি; এর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা তেমন নেই। কেন এ কথা বলছি? একটু ব্যাখ্যা করি। একটু আগেই বললাম যে আমরা একটা হিসাব কষছি। আমাদের হিসাব বলছে, প্রশ্ন ফাঁস বিষয়টিকে যদি অস্বীকার করে কাটিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তো ভালোই পরীক্ষাগুলো হয়ে যাচ্ছে, পরীক্ষার ফলাফল সময়মতো দেওয়া যাচ্ছে, ফিবছর আগের চেয়ে ফল ভালো হচ্ছে, আবার নতুন বছরে সঠিক সময়ে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে; তাহলে অসুবিধা কোথায়? আসলে অসুবিধা অনেক!

আমাদের ঘরে ঘরে আমাদের নতুন প্রজন্ম এখন বড় হচ্ছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দেখে তার উত্তর শিখে পরীক্ষা দিয়ে। আর তার সরাসরি পুরস্কারও তারা পাচ্ছে। কারণ অল্প পরিশ্রমেই তারা পরীক্ষায় ভালো করতে পারছে। অন্যদিকে যারা নৈতিকতা আঁকড়ে ধরে থাকছে, ফাঁস করা প্রশ্ন না দেখে থাকছে, পরীক্ষা দিচ্ছে, তারা পিছিয়ে পড়ছে। একসময় তারাও হয়তো হতাশ হয়ে নৈতিকতাকে আলমারিতে তুলে রাখছে আর নিজেদের ভাসিয়ে দিচ্ছে গড্ডলিকা প্রবাহে। আমি অনেকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছি এবং লক্ষ করেছি যে আমাদের অনেক অভিভাবক এখন মনে করছেন যে আসলে প্রশ্ন যদি ফাঁস হয়, তাহলে তা দেখার মধ্যে কোনো অন্যায় নেই। কারণ অন্য সবাই তা দেখছে। সুতরাং দেখাটাই বরং একটি ন্যায্য বিষয়; না দেখাটাই বোকামি (পড়ুন অন্যায়)। তাহলে দেখুন, আমাদের নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে এ রকম একটি যুক্তিতর্কের অবতারণার মধ্য দিয়ে। এই যুক্তিতে তারা ভবিষ্যতে অনেক অন্যায়কেই ন্যায় ভেবে করতে শিখবে। সবাই মিলে অন্যায় করলেও অন্যায় অন্যায়ই থাকে এ ধারণাই হয়তো তারা বিস্মৃত হবে কিংবা এ ধারণা তো তারা শিখবেই না। তাহলে বুঝুন আমরা আসলে সোনার দেশের জন্য আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আসলে কী শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছি।

বলছিলাম যে প্রশ্ন ফাঁস প্রতিহত করার জন্য বেশ কিছু প্রযুক্তিগত সমাধানের কথা আলোচনা হয়েছে বটে; কিন্তু সে সংক্রান্ত আর্থিক সংশ্লেষ হলো এ ধরনের কোনো সমাধান গ্রহণ করার সবচেয়ে বড় বাধা। আর এই আর্থিক সংশ্লেষ ও ঝামেলার হিসাব কষতে গিয়েই বোধ করি আমরা অস্বীকার করার নীতিকেই আঁকড়ে ধরে আছি। কিন্তু ওপরে যে বিষয়টি আলোচনা করলাম, তাতে কি পরিষ্কার নয় যে আমাদের সামনে কী দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে? তাই আমাদের আসলে সময় এসেছে দূরদর্শী হওয়ার। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছি; পদ্মা সেতুর মতো মহাপ্রকল্প সফলভাবে করতে আমরা আর অন্যের মুখাপেক্ষী নই। আমাদের জন্য কি খুবই কঠিন এমন একটি প্রকল্পের অর্থের জোগান দেওয়া, যেখানে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টিকে প্রযুক্তি দিয়ে মোকাবেলা করার প্রয়াস নেওয়া যায়? আমরা জানি একনেকে কত হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়মিত পাস হয় বা হচ্ছে; কোনো প্রকল্পের বিরুদ্ধে আমার কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু আমার আকুল আবেদন হলো, যত ঝামেলা হয় হোক, তা-ও প্রশ্ন ফাঁসকে স্বীকার করে এই প্রশ্ন ফাঁসকে প্রযুক্তিগতভাবে মোকাবেলা করার জন্য যত অর্থ লাগে লাগুক, দয়া করে তা খরচ করুন। দৃশ্যমান উন্নয়নের চেয়ে বিষয়টি এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : অধ্যাপক, সিএসই বিভাগ, বুয়েট

সূত্র: কালের কণ্ঠ

জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035269260406494