শিক্ষকদের অনশন ও আস্থার সংকট - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষকদের অনশন ও আস্থার সংকট

আমিরুল আলম খান |

নন-এমপিও শিক্ষকরা অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে অনশন ভঙ্গ করেছেন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির কাজও শুরু করেছে। ২০১৮ সালের শুরুতে শিক্ষকদের আন্দোলনে উত্তাল সময়ে এ খবর সবার জন্যই স্বস্তির। ২০০৫ সালের পর ২০১০-এ সর্বশেষ ১ হাজার ৬১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। তারপরও আরো সাত হাজারের কিছু বেশি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এমপিওবহির্ভূত আছে দীর্ঘ সাত বছর। ফলে লাখখানেক শিক্ষক কী রকম মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন, তা একমাত্র ভুক্তভোগীই উপলব্ধি করতে পারে।

২০১০ সালের পর শিক্ষকরা রাষ্ট্রের নাভিকেন্দ্র থেকে মাত্র ঢিল ছোড়া দূরত্বে শান্তিপূর্ণ নানা আন্দোলন, অনশন করেছেন মোট ১১ বার। এবার অন্তত আশ্বাস মিলেছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। এর আগে শিক্ষামন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের সব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে শিক্ষকদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে অনশন ভাঙার আবেদন জানালে আন্দোলনরত শিক্ষকরা তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন।

এবার যখন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একজন পদস্থ কর্মকর্তা সেই একই আশ্বাস শোনালেন, তখনই শিক্ষকরা আনন্দের সঙ্গে তা গ্রহণ করে অনশন ভঙ্গ করেছেন। ফলে গোটা দেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। সবাই আশা করছে এ বছর থেকে এই ৭ হাজার ১৪২টি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত হবে।

প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করতে সরকারের যে অতিরিক্ত ব্যয় হবে, তার হিসাব করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। তাতে দেখা যায়, সরকারের বার্ষিক ব্যয় হবে প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের শিক্ষালাভের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিকের শিক্ষা নিশ্চিত করতে সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। এবং সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ, তাদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদান, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহসহ শিক্ষালয়ের যাবতীয় ব্যয় বহনে রাষ্ট্র বাধ্য।

কিন্তু আমাদের ইতিহাস বলে, এ রাষ্ট্রে এমনকি মাত্র এক কুড়ি স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাও সরকার স্থাপন করেনি। দেশের প্রাথমিক থেকে ডিগ্রি কলেজ পর্যন্ত সবই স্থানীয় মানুষের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়ে এসেছে। অর্থাৎ শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের যে সাংবিধানিক দায়িত্ব, সে দায়িত্ব পালনে সব সরকারই অবহেলা দেখিয়েছে এবং নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এজন্য ৩০ লাখ প্রাণ বলি দিয়েছি আমরা। অথচ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার পূরণে রাষ্ট্রের অবহেলা ও নির্দয় আচরণ আমাদের চরমভাবে ব্যথিত করে।

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। অন্তত আমরা সেজন্য অহর্নিশ গর্ব করি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দাপ্তরিক মন্ত্রীর আশ্বাসের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা রাজকর্মচারীর কথা। অর্থাৎ এ রাষ্ট্রে কর্মচারীর কথার দাম থাকলেও মন্ত্রীর কথা মূল্যহীন! যে কথা এক রাজকর্মচারী বলেছেন, সেই একই কথা ও আশ্বাস তো স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী দিয়েছিলেন। আমরা ধরে নেব, তিনি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অভিমত জেনেই সে আশ্বাসবাণী শুনিয়েছিলেন। তবে তার দেয়া আশ্বাস অগ্রাহ্য হলো কেন? এটি হলো এ মন্ত্রীর প্রতি শিক্ষকদের আস্থার সংকট। এমন মন্ত্রিত্ব জলাঞ্জলি দিতে যদি কেউ বিবেকের দংশন অনুভব না করেন, সেটি এ লড়াকু জাতির জন্য লজ্জার কারণ বটে।

কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্রের ক্ষমতাবানরা অহর্নিশ বলে যাচ্ছেন, শিক্ষক সম্প্রদায় কত অধম। তাদের প্রতি অসম্মানজনক কথা বলেননি, ক্ষমতার কাছাকাছি এমন মানুষ এ দেশে কমই আছেন। বছরে মাত্র ২ হাজার ২০০ কোটি বরাদ্দ দিলে দেশের তাবৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা যায়— এ কথা সরকারের উচ্চমহলের অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু শিক্ষকদের জন্য, সেখানে যেসব কোমলমতি নিষ্পাপ শিশু লেখাপড়া করে, তাদের জন্যও কারো প্রাণে এতটুকু দয়ামায়া দেখিনি!

বেশ কিছুদিন ধরে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকদের যেভাবে শাপ-শাপান্ত করেছেন, অপরাধী হিসেবে সমাজের কাছে তাদের তুলে ধরেছেন, তাতে পুরো জাতি লজ্জায় অধোবদন হয়েছে। কিন্তু এ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন নানা প্রকল্পে যে সীমাহীন দুর্নীতি হচ্ছে, হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে এবং হচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি আশ্চর্যরূপে নীরব। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রকল্পগুলো সব দখল করে নিয়েছেন সরকারের আমলারা। সেখানে পুকুর নয়, সাগরচুরির খবর হররোজ মিডিয়ায় প্রকাশ হচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস তার নেই।

পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায় এককভাবে শিক্ষকের কাঁধে চাপানো গুরুতর অন্যায়। বিভিন্ন তদন্তে প্রশ্নপত্র ফাঁসে যেসব ডিভাইস ও প্রযুক্তি ব্যবহার হয় বলে জানা গেছে, তা এসব শিক্ষকের নাগালের বাইরে। তাছাড়া একটি মূল্যবোধহীন, জবাবদিহিবিহীন দেশে, যেখানে সুশাসন বলে কিছু নেই, সেখানে শুধু শিক্ষক মূল্যবোধ আঁকড়ে থাকবেন— এমন প্রত্যাশা জন্মায় কী করে? বিশেষ করে তাদের কাছ থেকে, যারা ৫ থেকে ১০-১২ লাখ টাকা দিয়ে এ মাস্টারি চাকরি কিনেছেন? মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। যে সাত হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় এত বছর ধরে ঝুলে আছে, তার প্রত্যেকটির স্বীকৃতি মিলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বীকৃতি দেয়ার অধিকারী হলো শিক্ষা বোর্ডগুলো।

সরকারের নির্ধারিত শর্ত পূরণ না করার কারণে শিক্ষা বোর্ড যেসব প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে, মন্ত্রণালয় হাজার হাজার নির্দেশনামা পাঠিয়ে সেগুলোকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করে। তাহলে মন্ত্রণালয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপে যেসব প্রতিষ্ঠান বোর্ডের স্বীকৃতি পেয়েছে, সেখানে কর্মরত শিক্ষকদের কেন বছরের পর বছর আন্দোলন করতে হলো শ্রমের ন্যূনতম মজুরি পাওয়ার জন্য?

এখন অনেকে এ প্রশ্ন তুলছেন, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নাকি দেশে স্থাপন করা হয়ে গেছে। তাও যদি হয়ে থাকে, সে দায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সরকারকেই বহন করতে হবে।

বাংলাদেশে বাংক থেকে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থ লোপাটের জন্য দায়ীদের নাম বলারও সাহস নেই এ রাষ্ট্রের। সোনালী, বেসিক, ফারমার্স ব্যাংক, শেয়ারমার্কেট লোপাটের নায়কদের রক্ষায় সবাই কেন সর্বপ্রযত্নে উদ্যোগী? কেন এসব লুটেরা প্রতিষ্ঠানকে গরিবের রক্ত পানি করা টাকা থেকে বরাদ্দ দিয়ে লাইফ সাপোর্ট দিতে হবে?

দেশে ব্যাংক ব্যবসা হয়ে উঠেছে লুটপাটের এক মৃগয়াক্ষেত্র। প্রয়োজনের অনেক বেশিসংখ্যক ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায়। আর সেসব ব্যাংকে লালবাতি জ্বললে জনগণের টাকা থেকে সেগুলোকে কোরামিন দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনের দিন শেষ। এখন দুর্বৃত্তদের লালন-পালনের দিন। আর সে খরচ বহন করে চলেছে এ দেশের গতরখাটা মানুষ।

লুটেরাদের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা দিতে যাদের এতটুকু কার্পণ্য নেই, তারাই আবার শিক্ষকদের ন্যায্যমজুরি থেকে বঞ্চিত করে রাখে বছরের পর বছর! শিক্ষকদের প্রতি এমন অবহেলা, অপমান ও দমন-পীড়ন কেবল বর্বরদের পক্ষেই সম্ভব।

লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, যশোর শিক্ষা বোর্ড

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004410982131958