আদিম যুগের মানুষ তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের তাগিদে নতুন নতুন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতো। ক্ষুধা নিবারণের জন্য নানা ধরনের খাবার খেয়ে সে সম্পর্কে ধারণা পেত। পাথরে পাথরে ঘর্ষণে যে আগুন জ্বলে সে সম্পর্কে তারা ধারণা লাভ করতো। হাতের ইশারায় বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে তারা বিষয়বস্তু উপস্থাপন করতে শিখলো। পরবর্তী সময়ে তারা পাথরে বা গাছের বাকলে দাগের মাধ্যমে হিসাব সংরক্ষণ করতো। তা থেকেই ধীরে ধীরে বর্ণ, শব্দ এবং পরিশেষে ভাষা উৎপত্তি হলো। এভাবে প্রয়োজনই তাদের ব্যাপক অসহায়ত্বের কবল থেকে মুক্ত করেছে।
প্রাচীন বাংলাদেশের ভাষা, সাহিত্য ও শিক্ষা আমাদের গর্ববোধ করার মতো। সে সময় মহাস্থানগড়ে পাথরে খোদিত একটি লিপি উৎকর্ষিত ছিল। ব্রাহ্মী অক্ষরে লেখা লিপিটির সময়কাল খিষ্ট্রপূর্ব তৃতীয় শতকে। পাল ও সেন যুগের শাসকরা নিজেরাও পন্ডিত ছিলেন ও সাহিত্য চর্চা করতেন। তাদের সভাকবিও ছিল। পাল যুগের তাম্র শাসনে বিধৃত প্রশস্তি অংশে সংস্কৃত ভাষা চর্চার শৈল্পিক মানসম্পন্ন কাব্য রচনার স্পষ্ট প্রমান আছে। কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত পাল যুগের প্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ। পাল আমলে রচনা করা হয়েছিল চর্যাপদ। চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন হিসাবে স্বীকৃত।
সেন রাজাগণ রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি নিজেরাও বিদ্যাচর্চা ও সাহিত্য রচনা করতেন। পন্ডিতদের সাহিত্য রচনায়ও উদ্বুদ্ধ করতেন। ‘দানসাগর’ও ‘অদ্ভুতসাগর’ রাজা বল্লাল সেনের রচনা। লক্ষণ সেন পন্ডিত ও কবি ছিলেন। পিতা বল্লাল সেনের অসমাপ্ত ‘অদ্ভুতসাগর’ তিনি সমাপ্ত করেন। সেনদের রাজসভায় পন্ডিত জ্ঞানী ও কবিদের সমাবেশ ঘটেছিল। জয়দেবের গীতগোবিন্দ ও কবীন্দ্র ধোয়ারির ‘পবনদূত’ কাব্য অমর সাহিত্যকর্ম। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে থাকা কবিতা সেন যুগের শেষ দিকে শ্রীধর দাস সংকলন করে নাম দেন ‘সদুক্তিকর্ণামুক্ত’।
পাল যুগের আগে বাংলাদেশের শিক্ষা সম্বন্ধে খুব বেশি জানা যায় না। তবে পাল যুগে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার দেখে অনুমান করা যায় মৌর্র্য ও গুপ্ত যুগেও শিক্ষার প্রচলন ছিল। বাংলাদেশে পাল যুগের অনেক বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কার হয়েছে। বিহারগুলো ছিল এক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে বৌদ্ধ ছাত্ররা এখানে পড়াশোনা করত। এখানকার শিক্ষকদের বলা হতো আচার্য বা ভিক্ষু। আর শিক্ষার্থীদের বলা হতো শ্রমণ। বর্তমান যুগের আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিহারেও ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা ছিল।
প্রাচীন বাংলাদেশের হিন্দুদের প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল তিন ধরনের। যেমন গুরুগৃহ, চতুষ্পাঠী এবং পাঠশালা। রাজা, মন্ত্রী বা অভিজাত পরিবারের ছেলেরা গুরুগৃহে পড়ার সুযোগ পেত। গুরু অর্থাৎ ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী বনের মধ্যে কুটির বানিয়ে থাকতেন। তাঁর কাছে রেখে আসা হতো ছাত্রদের। ছাত্ররা গুরুর বাড়িতেই থাকতো এবং গুরুর কাছে পড়াশোনা করতো। চতুষ্পাঠীতে পড়তে পারত কেবল ব্রাহ্মণ ঘরের ছেলেমেয়েরা। এখানে সংস্কৃতভাষা শেখানো হতো। যাতে টোলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে সুবিধা হয়। হিন্দুদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বলা হতো টোল। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ টোলের প্রধান পাঠ্য বিষয় ছিল।
বারো-তেরো শতকের মধ্যে ইউরোপের নানা দেশে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠে। যেমন- ইতালির বোলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ফ্রান্সের প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়, ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। অথচ অষ্টম শতকের মধ্যেই বাংলাদেশ, ভারতে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে অনেক বড় বড় বৌদ্ধ বিহার গড়ে উঠেছিল। এসব বিহারে শুধু ধর্মীয় বই পড়ানো হতো তা নয়, এখানে চিকিৎসাবিদ্যা, ব্যাকরণ, জ্যোতিষশাস্ত্রসহ নানা বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হতো। শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাচীন বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে ছিল।
ব্রিটিশ আমলে প্রাচীন বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা ছিল জমিদারকেন্দ্রিক। জমিদাররা তাদের সন্তানদের দেশের বাইর থেকে লেখাপড়া শিখাতেন। ইংরেজ আমলে ভারতবর্ষে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। এ দেশের সনাতন ধর্মাবালম্বীরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে প্রাচ্যের জ্ঞান সভ্যতা সম্পর্কে এগিয়ে থাকে। অপরদিকে, মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে ইংরেজি শিক্ষাকে বিধর্মীদের শিক্ষা বলে আখ্যায়িত করেছেন। মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করা পাপ বলে অপপ্রচার করে থাকেন। এর ফলে মুসলিম জনগোষ্ঠী আধুনিক শিক্ষা থেকে পিছিয়ে থাকে। সনাতন ধর্মের লোকেরা ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত হয়ে চাকরি ও ব্যবসা বাণিজ্যে সুযোগ লাভ করেন।
তখনকার সময়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রত্যেক বাড়ির কাচারি ঘর ছিল ধর্মীয় শিক্ষার মক্তব। ধর্মীয় শিক্ষায় দীক্ষিতরা সে মক্তবে সকালবেলা কায়দা, আমপারা ও কোরান শরীফ পড়াতেন। ধীরে ধীরে শিক্ষার স্বাদ জনগণের মাঝে বিস্তৃত হতে থাকে। সারাদেশে ব্যাপকভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল উপজেলা বা শহরে হাতেগোনা ২-১টি । বড় বড় শহর ছাড়া কলেজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না।
পাকিস্তান আমলের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বলতে গেলে এক কিলোমিটার পথ হেঁটে আমাকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়েছিল। বর্ষায় কর্দমাক্ত ফসলের খেতে (আইল) সরু পথ দিয়ে কখনও নৌকা, কখনও পানি ভেঙ্গে যেত হতো বিদ্যালয়ে। উচ্চ বিদ্যালয় যেন বর্তমান সময়ের বিদেশে উচ্চ শিক্ষার মতো ছিল। জুনিয়র হাইস্কুল তাও নতুন প্রতিষ্ঠিত ছয় কিলোমিটার দূরে। হাইস্কুলের সন্ধান পেয়েছিলাম চাঁদপুর জেলার হাজিগঞ্জ উপজেলার বলাখাল উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি বলাখালের জমিদারের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তাও বাড়ি থেকে দশ কিলোমিটার দূরে। কাদা, পানি, বৃষ্টি ও ঝড়ের মাঝেও বিদ্যালয়ে যেতে কোনো ক্লান্তি ছিল না। রোজদিন শুধু সকালে-বিকেলে হেঁটেই চলছি। গ্রামাঞ্চল তথা উপজেলায় কলেজের সন্ধান পাওয়া আরও দুরূহ। একমাত্র মহকুমা (বর্তমানে জেলা) শহরে ছিল একটি কলেজ।
১০ কিলোমিটার যেতে হয়েছিল মধুরোড রেলস্টেশনে। যেখান থেকে ট্রেনে যেতে হয়েছিল চাঁদপুর কালিবাড়ি রেলষ্টেশন পর্যন্ত। তারপরে পুনরায় হাফ কিলোমিটার পথ হেটে কলেজে যেতে হতো। তখনকার এত দীর্ঘপথ হেঁটে যাওয়ার মাঝে কোনো ক্লান্তি না থাকলেও আজকে সে হেঁটে চলার স্মৃতি মনে হলে অনেকটা নিজেই বিস্মিত হই। এ কি করে সম্ভব? আজকের শিক্ষার্থীরা কি সে সময়ের স্মৃতি বিশ্বাস করতে পারবে?
সাথীহীন দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে শেষ করতে হয়েছে সেই সময়ের শিক্ষা জীবন। পাকিস্তান আমলেও ১ম-৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত কোনো ইংরেজি বই ছিল না। শুধু বর্ণমালা শিখার কিঞ্চিত সুযোগ ছিল ৫ম শ্রেণিতে। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে আনুষ্ঠানিক বোর্ডের ইংরেজি পাঠ্য বই ছিল। সে সময় আমাদের ভাগ্যে আজকের মতো জানুয়ারি মাসে ১ তারিখে নতুন বই জুটতো না। আমাদের পুরাতন বইগুলো তিন ভাগের ১ ভাগ দামে বিক্রি করতাম দোকানদারের কাছে। আবার সেখান থেকে অর্ধেক দামে প্রয়োজনীয় পুরাতন বই কিনতাম। আমার বাড়ি ছিল চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার বদরপুর গ্রামে। সে গ্রাম থেকে ডাকাতিয়া নদীরপাড় দিয়ে হেঁটে নৌকায় নদীপার হতে হতো। তারপর দীর্ঘ ১৫ কিলোমিটার ফসলের মাঠের পর মাঠ পার হয়ে হাজিগঞ্জ বাজারে আসতে হতো। বড় মসজিদের পার্শ্বে প্রধান সড়কে বাজারের দিন অসংখ্য পুরাতন বই দোকান ছিল। পুরাতন বইয়ের ক্রেতা বেশির ভাগই ছিল ছাত্র। তখন প্রাথমিকের গণ্ডি পার হয়ে কোনো ছাত্রী চোখে পড়তো না।
সে আমলের শিক্ষকদের স্মৃতি আজ মনের মাঝে ভেসে উঠে। লেখাপড়া শেখানের ব্যাপারে বাড়ি বাড়ি যেয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের খোঁজখবর নিতো। তখন বাবা-মায়ের পাশাপাশি শিক্ষকদের শাসন ছিল অত্যন্ত কঠোর। পান থেকে চুন খসলেই শিক্ষকের হাতে জোরে জোরে বেত্রাঘাত করার ঘটনা আজও স্মৃতিতে ভাসছে। লেখাপড়া পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় অভ্যস্থ ছিল পুরো সমাজ। আজকের মতো আড্ডা, সিগারেট সেবন তখনকার দিনে ভাবা যায় না। বাবা-মা, পাড়া প্রতিবেশি, শিক্ষক সকলে ছিল একাকার। বড়দের প্রতি সম্মান আদব-কায়দা, সালামের খানিকটা বিচ্যুতি হলে খবরটা পৌঁছে যেত অভিভাবকের কানে। খাবারের মতো শাস্তিটাও যেন, রান্না করা থাকতো। শিক্ষকের শাস্তির পরও অভিভাবকের মাঝে কোনো প্রশ্ন ছিল না। তারা বলতো, ‘ওস্তাদের মাইর যেখানে পড়েছে, সেটুকু বেহেস্তে যাবে।’ শিক্ষকের প্রতি তাদের কী অকৃত্রিম আস্থা। শিক্ষকদের তারা বলে আসতেন, ‘হাড় আমার মাংস আপনাদের।’
সে সময়ে কোচিং, নোট ও গাইডের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না। উচ্চ বিদ্যালয়ের কাছাকাছি এলাকায় বাড়িতে শিক্ষার্থীর লেখাপড়া শেখানোর জন্য লজিং মাস্টার রাখা হতো। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে বিদ্যালয় থেকে ২ কিলোমিটার দূরে অলিপুর গ্রামের শেষ প্রান্তে আমার লজিং জীবনের স্মৃতি আজও মনের মাঝে উঁকি দেয়। তখন গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ সকাল বেলা শুকনা পোড়া মরিচ দিয়ে ১ থালা পান্তা ভাত খেয়ে ফেলতো। একদিন সকালে আমার ভাগ্যেও সে পান্তা এসে জুটলো। আর বিলম্ব না করে মায়ের হাতে রান্না করা গরম ভাত খাওয়ার জন্য লজিং ছেড়ে দিলাম।
স্বাধীনতার পর অনেক বছর পর্যন্ত নোট গাইড তথা কোচিং তেমন ছিল না। সৃজনশীল ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর এ ব্যবসার ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো। বিশেষ করে গোল্ডেন- জিপিএ-৫ ব্যবসাকেই তুঙ্গে নিয়ে যায়। তখন ৫ম শ্রেণি ও ৮ম শ্রেণির গুটিকয়েক শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ের ক্লাসশেষে বৃত্তির অবৈতনিক কোচিং করানো হতো। শিক্ষকদের স্বল্প বেতন পাওয়ায় সংসারের ব্যয় নির্বাহ ছিল অত্যন্ত কষ্টের। তাই তাঁরা বিত্তবান অভিভাবকদের একাধিক বাড়িতে গিয়ে ছাত্রদের পড়াতেন। আজ কোচিং ব্যবসা রমরমা অবস্থান। ভর্তি কোচিং, বিষয়ভিত্তিক কোচিংসহ হরেক রকম কোচিং। বর্তমানে কতিপয় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ঠিক মতো পাঠ্য বিষয় না বুঝিয়ে কোচিং সেন্টারের দিকে ধাবিত করছে। আমাদের সময়ে অনুশীনলীর মধ্য থেকে পরীক্ষায় প্রশ্ন আসতো। আমরা পুরো প্রশ্নটা বই থেকে আয়ত্ত করতাম। বর্তমানে বোর্ড বইয়ের অনুশীলন প্রশ্নের সাথে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের কোনো মিল নেই। প্রশ্নপত্রের মিল খুঁজে পাওয়ার জন্য শিক্ষক, অভিভাবক শিক্ষার্থী সকলে সংঘবদ্ধভাবে নোট গাইডকে তাদের প্রিয় সাথী হিসেবে বেছে নিয়েছে। পরীক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে যেমন শিক্ষক, বইয়ের ১ম প্যারা বা কিছু অংশ পড়াবেন, সেটুক শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জন করছে কিনা প্রতি পিরিয়ড প্রতি সপ্তাহে যাচাই করবেন। আমাদের সময় কোনো শিক্ষার্থী পড়া না পারলে বিদ্যালয়ের ছুটির শেষে পড়া শিখে যেত হতো। অথবা আগামী দিন সে পড়া শিক্ষক আদায় করতো। অপারগ শিশুদের বিশেষ পাঠের মাধ্যমে তাদের কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান অর্জন করাতে হবে। তাহলে শিক্ষা হয়ে উঠবে জ্ঞান অর্জনমুখী। দূর হবে নোট গাইড ও কোচিং বাণিজ্য।
পাকিস্তান আমলের শিক্ষকরা সামান্য বেতন পেত। গর্ভনর মোনায়েম খানের সময়ে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে বঙ্গভবন ঘেরাও করে প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রথম বেতন স্কেল প্রাপ্তি আদায় হয়। অপরদিকে, বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদের বেতন থেকে স্থান কাল ভেদে শিক্ষকরা সামান্য বেতন পেত। তখন শিক্ষকতার পেশা ছিল আদর্শ ও সম্মানের। তখন আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের জন্য গাছের আম কাঁঠালসহ বিভিন্ন ধরনের ফল নিয়ে যেতাম। শিক্ষার্থীরদের অভিভাবকেরাও শিক্ষকদের দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে আপ্যায়ন করতেন। কী মধুর ছিল শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মাঝে হৃদয়ের অনুভূতি।
প্রাথমিক শিক্ষকেরা সকল পেশাজীবীদের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের সাধারণ মানুষের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা ও প্রাথমিক শিক্ষকদের ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ স্বাধীনতার ঊষালগ্নে প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণ করেন। সে আমলের বাংলাদেশ যুদ্ধ বিধস্ত সীমাহীন অভাবের মাঝে অবস্থান করেছিল। এ মহানায়ক, বিশাল হৃদয়ের অধিকারীর পক্ষেই তখন সম্ভব হয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণ করা। আজ তিনি বেঁচে থাকলে শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য আন্দোলন করতে হতো না। শিক্ষা ও শিক্ষকদের সকল বৈষম্য দূর হতো। আজ মুজিববর্ষে তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
নানা ধরনের বৈষম্যের বেড়াজালে শিক্ষকদের অবস্থান থাকলেও পূর্বের তুলনায় তাঁদের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক মন্ত্রী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের বক্তব্যে বলে আসছেন- প্রাথমিক শিক্ষকরা বেশি বেতন পাচ্ছেন। বিষয়টি অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এ দেশের সকল কর্মচারী, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীসহ সকলকে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি বেতন দিয়ে আসছেন। যদিও সরকারি বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য থাকা কাম্য নয়। তারপরও তাঁদেরও পূর্বের তুলনায় সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ পূর্বের তুলনায় তারা শিক্ষার্থীদের ওপর ভালোবাসা উজাড় করে দিতে সক্ষম হয়নি। তাঁদের ভালবাসা ভাগ করে দিচ্ছেন, ম্যানেজিং কমিটি, কর্মকর্তা ও পাঠদান বর্হিভূত কাজের ক্ষেত্রে। অনেকেই শিক্ষকতাকে চাকরি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এ ধারণা থেকে শিক্ষকতা যে মহান ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পেশা এ কথাটি বেমালুম ভুলে গেছেন। শিক্ষকতা জাতিকে উন্নতির অভিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র পেশা। এ বোধটুকু মন্ত্রী, সচিব, কর্মকর্তা, পরিচালনা কমিটি, অভিভাবকদের মাঝেও খুব কম দেখা যাচ্ছে।
দীর্ঘ ১ দশকে বিশাল অর্জন হলেও বৈষম্যের মাঝে এখনো হাবুডুবু খাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। বেসরকারি ও সরকারি শিক্ষকদের মাঝে বেতন, মর্যাদাসহ নানা সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য। শিশু শিক্ষায় বহু ধরনের বৈষম্য। এর ফলে শিশু শিক্ষায় আজও বেহাল দশা। যত্রতত্র গড়ে ওঠা বেসরকারি ও কিন্ডারগার্টেনে প্রশিক্ষণবিহীন ও স্বল্পশিক্ষিত শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত। যার ফলে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বাণিজ্যের খাতিরে বই, খাতার বোঝা বইতে হচ্ছে ছোট সোনামনিদের। শিশুর মেধা বিকাশের পরিবর্তে বিনাশ হতে থাকে। শিশু শিক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এদিকে সুদৃষ্টি দেয়া তো দূরের কথা, দৃষ্টি দেয়াও দৃশ্যমান নয়। তাদের অন্ধের মতো বসে থাকা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের প্রতি অবহেলার শামিল।
এদিকে বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারিকৃত বিদ্যালয়গুলোর অস্তিত্ব বিপন্নের দিকে ঠেলে দিচ্ছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরবতা। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকদের মাঝ থেকে বৈষম্য শূণ্যের কোটায় নামিয়ে আনতে হবে। উন্নত বিশ্বের পর্যায়ে শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে পারলে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নও প্রতিষ্ঠিত হবে। এ জন্য শিক্ষকসহ সর্বস্তরের জবাবদিহি প্রয়োজন।
শিক্ষকদের দিতে হবে যথাযথ মর্যাদা ও বেতন স্কেল। শিক্ষার্থীর প্রতি আন্তরিকতা গড়ে উঠুক শিক্ষকসহ সকলের মাঝে। এ হোক মুজিব বর্ষের প্রত্যাশা।
মো. সিদ্দিকুর রহমান : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।