স্মৃতি আনন্দের স্মৃতি বেদনার - দৈনিকশিক্ষা

স্মৃতি আনন্দের স্মৃতি বেদনার

কে জি মোস্তফা |

স্মৃতি যেমন আনন্দের, তেমনি বেদনার। বলছিলাম বরেণ্য সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সুবল দাশের কথা। সুরকার হিসাবে তাঁর  প্রথম চলচ্চিত্র ‘আকাশ আর মাটি’মুক্তি পায় ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে। গীতিকার হিসেবে আমার প্রথম ছায়াছবি ‘রাজধানীর বুকে’ মুক্তি পায় ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে। সময়ের ব্যবধান খুব বেশি নয়, মাত্র তিন বছর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, সুরকার ও গীতিকার হিসেবে আমাদের দুজনের মধ্যে তখনও সংযোগ ঘটেনি। সুবলদা অসংখ্য চলচ্চিত্রে সুরারোপ করেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি উর্দু ছবিও রয়েছে। 

সুরকার সুবল দাশের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে আমি ভালভাবেই ওয়াকিফহাল ছিলাম। যদিও আমাদের পরস্পরের মধ্যে তখনও পরিচয় ঘটেনি। কিন্তু তার অসংখ্য জনপ্রিয় গান অন্যান্য শ্রোতার মতো আমাকেও আবিষ্ট করে রাখত। 
চলচ্চিত্রে আমি  নন্দিত সুরকার রবীন ঘোষের সাথেই বেশি কাজ করেছি। ষাট দশক থেকে আজ অবধি আমার লেখা যে কটি গান এখনও সমান জনপ্রিয় হয়ে আছে, তার বেশির ভাগই রবীন ঘোষের সুরারোপিত। এ ছাড়া আমি কাদের জামেরী, আলতাফ মাহমুদ, করিম শাহাবুদ্দিন, বশির আহমদ, আবেদ হোসেন খান, ননী চ্যাটার্জি, সমর দাস, হেনরী গিলবার্ট, কুলেন্দু দাস, ধীর আলি মিয়া, ফজলুল হক, আবদুল হালিম চৌধুরী, খন্দকার নুরুল আলম, রাজা হোসেন খান, আনওয়ার উদ্দিন খান প্রমুখের সুরে কখনও চলচ্চিত্র, কখনও রেডিও, কখনও বা টিভির জন্য গান লিখেছি। কিন্তু সুবল দাশের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য আমার তখনও হয়ে ওঠেনি। 

২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ললিত কলাবিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন ‘সফেন’ কয়েকজন সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের সাথে গীতিকার হিসেবে আমাকেও সম্মাননা ও পদক প্রদান করে। জাতীয় যাদুঘরে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে সুবল দাস ছিলেন বিশেষ অতিথি। মূলত তিনিই সবার হাতে পদক তুলে দেন। আনুষ্ঠানিক পর্ব শেষ হলে সুবলদা সামনের সারিতে আমার পাশে এসে বসলেন। পরবর্তী কর্মসূচি ছিল বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গীত পরিবেশনা। তারই প্রস্তুতি চলার ফাঁকে সুবলদা অত্যন্ত হৃদ্যতার সাথে আমার সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন, যেন আমি তাঁর বহু পরিচিত, তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের একজন। আমি ভীষণ কুণ্ঠিত ও অভিভূত হয়ে পড়লাম. যখন তিনি আমার লেখা গানের চরণ গুনগুন করে শোনাতে লাগলেন। আমাকে বারবার অনুরোধ করলেন গান লিখতে, তিনি সুরারোপ করবেন। আমি বিনীতভাবে জানালাম, গান লিখছি না প্রায় ১০ বছর, এখন কি আর সম্ভব? অবশ্য ভেতরে ভেতরে লোভও হচ্ছিল। সুবল দাসের সুরে আমার গান হোক, সে তো আমার সৌভাগ্য। কিন্তু সে গানের উপলক্ষ কী? প্রচারের ব্যবস্থাই বা কী হবে?  

ঘটনাক্রমে কিছুদিনের মধ্যে ‘পঞ্চস্বর’ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের শিল্পীদের পক্ষ থেকে গান লেখার অনুরোধ আসল। তারা নিজ ব্যয়ে একটি অডিও সিডি-ক্যাসেট প্রকাশ করবেন। আমি সুবলদাকে টেলিফোনে সে কথা জানালাম, তিনি সোৎসাহে রাজি হয়ে গেলেন। আমি অবশ্য একটু দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লাম। কেননা আগে কখনও তাঁর সুরে গান লিখিনি। তাছাড়া অনেকদিন ধরে আমার গান লেখাও হয়নি। যাই হোক প্রথম যে গানটি লিখলাম, তার প্রথম চরণ- ‘আমায় একলা রেখে/ তৃষ্ণা আমার হারিয়ে গেছে/শোক-পাথরের মেঘে’। তিনি কথার মর্ম জানতে চাইলেন।  সাধারণত কোনও সুরকার তা জানার প্রয়োজন মনে করেন না। তিনি বললেন, কথার মর্ম জানা থাকলে সুরের সঠিক মেজাজ আসে। যাই হোক, আমি বললাম, এখানে তৃষ্ণা কোন মানবী নয়, তৃষ্ণা হচ্ছে মোহমায়া, যা একসময় মানুষকে ছেড়ে চলে যায়। মানুষ তখন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। এই নিঃসঙ্গতাই সম্ভবত মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় সঙ্কট। সুবলদা সোৎসাহে বলে উঠলেন, আপনি তো আমার বর্তমান মনের অবস্থাই লিখে ফেললেন। বাইরে আমার বলতে সবই আছে, কিন্তু কেউ আমার মনের নিঃসঙ্গতা টের পায় না। সে যাই হোক, প্রায় প্রতিদিনই তাঁর সাথে টেলিফোনে আলাপ হতো এবং টেলিফোনেই তাঁকে গানের চরণ শোনাতাম। তিনি কখনও নিজে কখনও বা মেয়েকে দিয়ে লিখে নিতেন। এভাবে স্বল্প সময়ের মধ্যে গানগুলো তৈরি হয়ে গেল। 

এবার শিল্পীদের কণ্ঠে গান তুলে দেবার পালা। পূর্বনির্ধারিত দিনে পঞ্চস্বরের প্রধান ইফতেখারুল ইসলামসহ (টিটন) শিল্পীদের নিয়ে আমি তাঁর মগবাজারের বাসায় হাজির হলাম। সাদরে তিনি আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। উষ্ণ আতিথেয়তায় এবং হাস্যে লাস্যে দিলখোলা আলাপ-আলোচনায় প্রাণের পরশ ছড়িয়ে দিলেন। বিরাট দেহের প্রাণবন্ত মানুষটি আসলে নিষ্পাপ শিশুর মতো সরল ছিলেন। সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁর সুযোগ্য সন্তান সুরকার সজল দাশ ও জ্যেষ্ঠা কন্যা সুগায়িকা অর্পনা দাশগুপ্ত (রীতা)। রীতার কণ্ঠে গানগুলো আগেই তোলা ছিল। রীতার কণ্ঠ যেমন চর্চিত, তেমনি সুললিত। একে একে রীতা সবকটি গান গেয়ে শোনালেন। পরবর্তীতে রীতার কন্ঠে ক্যাসেটে ধারণ করে গানগুলো শিল্পীদের দেয়া হলো। রীতা জানালেন, এটা ছিল সুবলদার গান শেখাবার পদ্ধতি। অর্থাৎ তিনি গান সুর করে প্রথমে রীতার কণ্ঠে শুনতেন। প্রয়োজনে পরস্পর পরামর্শ করে টুকটাক বদলাতেন। 

যাই হোক, আমার লেখা গানের  প্রশংসা এবং আমার প্রতি সুবলদার উষ্ণ আবেগ ও অন্তরঙ্গতায় অল্পসময়ের মধ্যে আমি ওই সিডির জন্য মোট ১৪টি গান লিখে ফেললাম। অবশ্য তিনি সুর করেছিলেন ৬টি। বাকিগুলো দুজন তরুণ সুরকারের সুর। সম্ভবত ওই ৬টি গানই ছিল সুবল দাশের জীবনের সর্বশেষ সুর করা গান। 

সুবল দাসের সর্বশেষ সুরারোপিত অডিও ক্যাসেট ও সিডি ‘তৃষ্ণা আমার হারিয়ে গেছে’প্রকাশিত হয়েছিলো ১৫ই জুলাই, ২০০৫। জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে আয়োজিত এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট সঙ্গীতব্যক্তিত্ব কলিম শরাফী এর মোড়ক উন্মোচন করেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে রবীন ঘোষ ও মোবারক হোসেন খান উপস্থিত ছিলেন। এতে অবশ্যই সুবল দাসের উপস্থিত থাকার কথা। কিন্তু  অসুস্থতার কারণে উপস্থিত হতে পারেননি। দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে তিনি একটি লিখিত বাণী পাঠান। সেটি নিম্নরূপ : প্রিয় সুধিবৃন্দ, আপনাদের সকলকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। শারীরিক অসুস্থতার জন্য আজকের এই সুন্দর সন্ধ্যায় আমি আপনাদের মধ্যে উপস্থিত হতে পারিনি। এ জন্য আন্তরিকভাবে ব্যথিত। আপনাদের সান্নিধ্য আমাকে আরও উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করত। 

জনাব কে জি মোস্তফা একজন গুণী মানুষ। তার প্রত্যক্ষ প্রেরণায় একদল উদ্যমী ছেলেমেয়ে গড়ে তুলেছে ‘পঞ্চস্বর’। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ‘তৃষ্ণা আমার হারিয়ে গেছে’ শীর্ষক সিডির এই গানগুলো। আমার বিশ্বাস, গানগুলো আপনাদের অবশ্যই ভাল লাগবে। কে জি মোস্তফাকে নতুন করে খুঁজে পাবেন। 
আপনারা দোয়া করবেন, আমি যেন সুস্থ হয়ে আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারি নতুন সুর ও গান নিয়ে। আপনারা সবাই সুস্থ ও ভাল থাকুন

-সুবল দাস

কিন্তু সুবলদা আমাদের মাঝে আর ফিরে আসেননি।  ১৫ আগস্ট, ২০০৫ কলকাতার এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অগণিত গুণগ্রাহীকে শোকসাগরে ভাসিয়ে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। প্রসঙ্গত ওই একই তারিখে আমেরিকার পপসম্রাট এলভিস প্রিসলিও মারা যান। আগেই বলেছি, বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণের শুরুর সময় অর্থাৎ সে পঞ্চাশের দশকেই সুবল দাস সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ভাবতে অবাক লাগে তিনি ৩০০টি ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। এ দেশের খ্যাতিমান সব শিল্পীই তাঁর সুরে কণ্ঠ দিয়েছেন। তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গান আজও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখে। প্রায় প্রত্যেক দিনই টিভির কোন না কোন চ্যানেলে তাঁর সুরকরা গান আমরা শুনতে পাই। কিন্তু কোন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার তাঁর ভাগ্যে জোটেনি।
সুবলদার আত্মার শান্তি হোক, কায়মনোবাক্যে এটাই প্রার্থনা। 
                           
  লেখক : গীতিকার, কবি, কলামিস্ট

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039260387420654