হৃদরোগ চিকিৎসায় সঙ্কট - দৈনিকশিক্ষা

হৃদরোগ চিকিৎসায় সঙ্কট

রহমান মৃধা |

দেশের প্রধান কয়েকটি হাসপাতালে হৃদরোগ চিকিৎসায় সংকটাবস্থা বিরাজ করছে। সব ধরনের হৃদরোগ চিকিৎসার একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার সংস্কারের দোহাই দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিভাগের সবগুলো ক্যাথল্যাব মেশিন অকেজো হয়ে আছে। ফলে সেখানে বন্ধ রয়েছে সব ধরনের এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্টি। চিকিৎসার জন্য রোগীরা মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে গেলেও শয্যা সঙ্কটের কারণ দেখিয়ে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।

যন্ত্রপাতির অভাবে রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে না। কারণ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে সংস্কার কাজ চলছে। তবে এ অবস্থা কতদিন থাকবে সে বিষয়ে কিছুই বলতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।

যেসব রোগীর জটিল (শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক) ভাসকুলার সার্জারি, বাইপাস সার্জারি, সিএপিজি, ভাল্ব প্রতিস্থাপন বা চিকিৎসার প্রয়োজন তাদের ফিরে যেতে হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব রোগী দ্রুত উপযুক্ত চিকিৎসা না পেলে মৃত্যুঝুঁকি..কিন্তু তা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। সংশ্লিষ্টরা জানান, হৃদরোগ হাসপাতালে ৫টি অপারেশন থিয়েটার বা ওটি রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিদিন অন্তত তিনটি ওটিতে কাজ চলে। এসব ওটিতে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫টি ওপেন হার্ট সার্জারি হয়ে থাকে। কিন্তু ওটি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের কারণে সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচানোর এসব জটিল অস্ত্রোপচার স্থগিত থাকছে। এতে করে বিপুলসংখ্যক রোগীর চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে। বাড়ছে তাদের মৃত্যুঝুঁকিও। এসব হাসপাতালের মেশিনগুলো বছরের পর বছর নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। 

কিছু মেশিন ইতোপূর্বে দু’বার রিপেয়ার করা হলেও এগুলো দিয়ে বেশিদিন কাজ চালানো সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে শিশুদের জন্য নির্ধারিত পেডিয়াট্রিক ক্যাথল্যাবটিও বেশ কিছুদিন ধরে নষ্ট। এ মেশিনটি ঠিক করতে কোটি টাকা প্রয়োজন। তবে মেশিনটির ওয়ারেন্টি পিরিয়ডও প্রায় শেষ। এ কারণে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সব ধরণের এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্টি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। ফলে রোগীদের অনেকে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে। কেউবা হৃদরোগ হাসপাতালের দ্বারস্থ হচ্ছে। আবার কেউবা বেসরকারি হাসপাতালের দালালের খপ্পরে পড়ে চিকিৎসার নামে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন! কিছু কিছু মেশিন অনেক পুরনো হয়ে যাওয়ায় রিপেয়ার করেও কাজ চালানো যাচ্ছে না। এমনও দেখা যাচ্ছে এক্স-রে টিউব নষ্ট হয়ে গেছে। এ টিউবটি ঠিক করতে প্রায় এক কোটি টাকা প্রয়োজন। বর্তমান পরিস্থিতিতে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর ঘটনা নতুন কিছু না, তবে প্রশ্ন থেকে যায় তার পরিমাণ কত? এদিকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় উভয়ই কমেছে।

এসব পূরণ করতে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশ্বের ধনী দেশগুলো রিজার্ভ যাতে নষ্ট না হয় সে চেষ্টা করে চলছে অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার সেটা কতো দ্রুত শেষ করতে হবে তা নিয়ে প্ল্যান করছে। সবকিছু জানার পর মনে হচ্ছে প্রবাসী, গার্মেন্টস শ্রমিক, দিনমজুর, মেহনতি মানুষরাই দেশটাকে টিকিয়ে রেখেছে আর ধনীরা দেশের অর্থ, সম্পদ ধনীরামপুরে পাচার করে দিচ্ছেন।

যাই হোক বিদেশি টাকার অভাবে এখন দেশের যন্ত্রপাতি থেকে অনেক কিছু অচল হওয়ার পথে। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছেন, এসব সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন মেশিন আনা দরকার। হৃদরোগ চিকিৎসায় জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের পরেই ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের অবস্থান। সেখানেও সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। দেশের একটি দরিদ্র ছেলের হৃদপিন্ডে ফুটো ধরা পড়েছে। আমাকে তার জন্য কিছু করতে বলা হয়েছে। তার চিকিৎসার সাহায্য পেতে আমাকে নানা জায়গায় নক করতে হয়েছে। সব জায়গা নক করতে গিয়ে এত কিছু জানা আর জানা থেকে বিষয়গুলো সবার সঙ্গে শেয়ার করা। কারণ, আমি একটি মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসার জন্য খুলনা থেকে শুরু করে ঢাকার এসব হাসপাতালের কয়েকজন ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে এসব কথা জানতে পারি।

শিশুদের মধ্যে সাধারণত যে ধরনের হার্টের রোগ দেখা যায় তা জন্মগত বা কনজেনিটাল। জন্মগত হার্টের রোগ নানা রকম হতে পারে, যার অন্যতম হার্টে ফুটো থাকা। হার্টের মধ্যেকার এই ফুটোর কারণে বাচ্চার বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে কিংবা ঘন ঘন সংক্রমণও ঘটতে পারে। তাছাড়া তাদের হার্টের ওপর অবাঞ্ছিত চাপ তো পড়েই। যদি ফুটো খুব ছোট হয়, তবে বাচ্চার তেমন কোনো উপসর্গ নজরে পড়ে না। তবে ছিদ্রটি যত বড় হবে ততো তাড়াতাড়ি সেটি ধরা পড়বে। অনেক সময় জন্মের পর পরেই শিশুর অসুবিধাটা বোঝা যায়। 

বেশিদিনের কথা নয়, আমার পরিচিত সুইডেনে সদ্য জন্ম নেয়া একটি শিশুর হৃদয়ে ফুটো ধরা পড়ে তখন তার কুঁচকিতে যে দুটি প্রধান শিরা, সেই শিরার মধ্যে ফুটো করে ক্যাথেটার বা সরু তার ঢুকিয়ে একেবারে হার্টের ভেতরে পৌঁছে..যেখানে ফুটো আছে সেখানে বিশেষ ধরনের বোতাম (বা ডিভাইস) লাগিয়ে ফুটোকে দু’পাশ থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়। সেই সময়ে বাচ্চাটি বুঝতেই পারে না তার শরীরে ঠিক কী করা হলো, কিংবা তার ব্যথাও লাগে না। এই পদ্ধতির জন্য আনুমানিক এক-দেড় ঘন্টা মতো সময় লাগে। এর পরে ৩-৪ ঘন্টা পরে বাচ্চাটির জ্ঞান ফিরে এলে তাকে ওয়ার্ডে দিয়ে দেয়া হয়। 

একদিন হাসপাতালে রেখে বাচ্চাটিকে ছেড়ে দেয়া হয়। এই পদ্ধতির জন্য কোনো কাটাকাটির দরকার হয় না, মোটেই রক্তপাত হয় না। দক্ষ হাতে এবং আদর্শ পরিবেশে করা হলে এই পদ্ধতি খুবই সুরক্ষিত। অনেক সময় হার্টের শিরার মুখ বন্ধ থাকে। ভাল্বের সমস্যা থাকে। সেক্ষেত্রে ক্যাথল্যাবে নিয়ে গিয়ে বেলুন ফুলিয়ে শিরার বন্ধ মুখ খুলে দেয়া হয়। গোটা বিশ্ব জুড়েই শিশুদের জন্মগত হার্টের সমস্যায় এখন এই ধরনের চিকিৎসা চলছে। আগের তুলনায় এই সব রোগের ব্যাপারে মানুষের চেতনা যে অনেকখানি বেড়েছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বাচ্চার উপসর্গ দেখে আজকাল অনেক বাবা-মা সমস্যার আঁচ অনুভব করতে পারেন। আর তাই বর্তমানে বহু অভিভাবক বাচ্চাদের হার্ট সংক্রান্ত রোগ নিয়ে কার্ডিওলজিস্টদের কাছে পরামর্শের জন্য আসছেন।

আগে এই ধরনের সমস্যার একমাত্র সমাধান ছিলো ওপেন হার্ট সার্জারি। তখন পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি ইন্টারভেনশন, মানে বর্তমানে ক্যাথল্যাবে নিয়ে গিয়ে যে ধরনের প্রসিডিওর করা হয় (যাকে অনেকে মাইক্রোসার্জারিও বলে থাকেন) তা আজকের মতো উন্নত ছিলো না। গত ২০-৩০ বছর ধরে এই চিকিৎসার ধীরে ধীরে উন্নতি ঘটেছে। ফলে বর্তমান প্রজন্মের কাছে একজন পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্টের ভূমিকা অনেক বেড়ে গেছে। যাই হোক, শেষে কোন উপায় না পেয়ে মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে রোগীর চিকিৎসার জন্য যোগাযোগ করি। আশা করি রোগী সেখানে সুচিকিৎসা পাবে।

আমার পুরো লেখাটি পড়লে প্রশ্ন জাগবে, এতগুলো ঘটনা কেনো জড়িত এখানে? এবং একটির সঙ্গে আরেকটির কী সম্পর্ক? সম্পর্ক আছে, কারণ মানুষের মনুষ্যত্ব এবং বিবেকের অবনতির পেছনে একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। বায়ুদূষণে মনও দূষণ হয়, মনের কলুষতা, বিবেকের অবক্ষয়, শিক্ষার অধঃপতন, গণতন্ত্রের বিসর্জন সবকিছু বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তবুও আমি শুধু একটি বিষয়ের ওপর রিফ্লেক্ট করবো সেটা হলো শিক্ষা। এতো টাকা খরচ করে বিদেশে পড়ে কী আমরা সঠিক শিক্ষা অর্জন করছি? নাকি আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক তাই যার যা খুশি তাই করছি? এর নাম তো স্বাধীনতা নয়! স্বাধীনতা মানে তো দায়িত্ব। সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে।

আমি ঘুষ, দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে বলতে শুরু করেছি,‘ক্ষান্ত হও’, ‘বদলে যাও’, ‘বদলে দাও’, ‘ভালো হও’ লেখা সংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ছুটতে চাচ্ছি। এতে দুর্নীতি-দুঃশাসন কমবে না। তারপরও মনের তাগিদে প্রতিবাদ করছি। এগুলো দেখলে কোনো না কোনো দুর্নীতিবাজ যদি লজ্জা পায়! দুর্নীতি-দুঃশাসন, অর্থপাচার ও নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী স্মারকলিপি দেয়ার কর্মসূচি শুরু করবো বলে মনে মনে ভাবছি। কিন্তু তাতে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব হবে কী? 

এখন ভাবুন দুর্নীতি একটা দেশের কতো বড় ক্ষতি করতে পারে। এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর নেই। একবার উপলব্ধি করুন, যদি প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুষ না থাকতো, খেলোয়াড় বাছাই করতে দুর্নীতি করা না হতো, তবে এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলোতেও আজ বিশ্ববিখ্যাত তারকা খেলোয়াড়দের জায়গা হতো।

লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার

 

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030891895294189