ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বেশি মামলা করছেন। ৮১ দশমিক ৭ শতাংশ মামলা করেছেন সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা। এর মধ্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও আছেন। অনিয়মে অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তারাও আছেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে এক গবেষণার ভিত্তিতে এসব তথ্য জানান যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
গতকাল সোমবার সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) অনলাইনে আইনটি নিয়ে একটি আলোচনাসভার আয়োজন করে। এতে গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ কিভাবে প্রয়োগ হচ্ছে’ শিরোনামে গবেষণার প্রাপ্ত তথ্য তুলে ধরেন আলী রীয়াজ।
সরকার অনুমোদিত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, অভিযুক্ত বা তাঁদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধব, অভিযুক্তের আইনজীবী এবং থানা ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের তথ্য মতে, জানুয়ারি ২০২০ থেকে আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সারা দেশে ৬৯৯টি মামলা হয়েছে। সাইবার ট্রাইব্যুনালের হিসাবে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) মামলা হয়েছে আট শর বেশি। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) ১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ২৫ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত ৪২৬টি মামলার তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছে। এই ৪২৬টি মামলায় মোট অভিযুক্ত ৯১৩ জন।
এ পর্যন্ত আটক হয়েছে ২৭৩ জন। মোট অভিযোগকারী ৪২৬ জন।
গবেষণায় প্রাপ্ত এসব তথ্য তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, ‘অভিযুক্তদের বড় অংশ সাংবাদিক। অভিযুক্তদের মধ্যে রাজনীতিবিদের সংখ্যা বেশি। তবে আটকের ক্ষেত্রে সাংবাদিকের সংখ্যা বেশি। ৮০ শতাংশের বেশি তরুণ সাংবাদিক। তুলনামূলকভাবে সাংবাদিকরা বেশি বিপদের মধ্যে পড়েছেন। ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরা বেশি আটক হচ্ছেন। শিক্ষকরাও এই আইনের জন্য বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। দুজন শিক্ষককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জনকে আটক করা হয়েছে। সার্বিক অভিযুক্তদের ৮০ শতাংশ ১৮ থেকে ৪০ বছরের। অর্থাৎ তরুণরাই বেশি অভিযুক্ত।’
সভাটি সঞ্চালনা করেন সিজিএস নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর মাধ্যমে এটি মোটামুটি প্রমাণিত চিন্তা ও বাকস্বাধীনতা অনেকটা খর্ব হয়েছে। এই আইনের অধীনে একজন লেখকের কারাগারে বন্দি অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ মামলা নিষ্পত্তির দিকে যায় না। মাত্র দুটি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংজ্ঞাটা অস্বচ্ছ। এর মাধ্যমে যেকোনোভাবে যে কাউকে মামলা দিয়ে দেওয়া যাবে। মামলার পর পুলিশ পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার ও তল্লাশি করতে পারে।’ জামিনযোগ্য মামলায় জামিন না দিয়ে এই আইনের অপ্রয়োগ করা হয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সমাজের মধ্যে আতঙ্ক ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরাও আছেন এই কাতারে। একজন নাগরিকের স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক চিন্তা থাকার কথা। এই আইনের কারণে সেটা বিপজ্জনক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।’
জাসদের সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমস্যা ও প্রয়োগ কোথায়, কী নিয়ে হচ্ছে, তা গবেষণা করা প্রয়োজন। ভিন্নমত পোষণ করার জন্য জামিন দিয়ে মামলা চালাতে পারে সরকার। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার সিদ্ধান্তে আমি একমত নই। ডিজিটাল সমাজ ব্যবস্থাপনার জন্য সামঞ্জস্য করার জন্য আইনের দরকার আছে। সেই আইন কার্যকর করার সময় দেশের সংবিধান, বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে।’
সিজিএসের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটি অপআইন। সব আইনের একটি দর্শন আছে। আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হলে তদন্তকারী সংস্থা তদন্ত করে দেখবে। কিন্তু এই আইনে অভিযোগ করলেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এই আইন আমাদের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য নয়।’