প্রাথমিকের দৌড় - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিকের দৌড়

সিদ্দিকুর রহমান |

শিক্ষা জীবন শেষ করে শিক্ষকতায় এসে আজও ভয়ে পিছু ছাড়ছে না সেই প্রাথমিকের দৌড়। প্রাথমিকে দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রায়ই পুরস্কার পেতাম। জীর্ণ শীর্ণ দেহে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা অনেকটা মুখরোচক গল্পের মত মনে হয়। শরীরের এমন বেহাল দশা যে, একটুখানি জোরে বাতাস হলে অনেকটা চিৎ-কাত হয়ে পড়তাম। শিশুকাল থেকে আজও নানা ধরণের হিসাব নিকাশ খুব সহজে সমাধান করতে অভ্যস্ত। শুধু নিজের জীবনে হিসাব মিলাতে পারিনি। তখনকার সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ক্রীড়ানুষ্ঠানে অংক দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো।

সে দৌড়ে অংশগ্রহণ করে কৃতিত্ব অর্জন করেছিলাম। এবার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাকালীন সময়ের একটা বাস্তব ঘটনা উপস্থাপন করছি। তিন বন্ধু একসাথে সন্ধ্যার পর কাছারি ঘরে লেখাপড়ার পাশাপাশি গল্প-গুজব করতাম। আমাদের বাড়ির পাশে ছিল হিন্দু বাড়ি। সে বাড়ির একজন ভদ্র লোক প্রায়ই ডাকাতিয়া নদী থেকে জাল ফেলে মাছ ধরতেন। সে মাছ নিয়ে কাছারি ঘরের পাশ দিয়ে বাড়ি যেতেন। হঠাৎ তিন বন্ধু মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি উদয় হলো। কী করে তার মাছগুলো আত্মসাৎ করা যায়? সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে তিনবন্ধু পর্যাপ্ত মাটির ঢিল নিয়ে জঙ্গলে তিনটি গাছের ডালে অবস্থান করেছিলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর এলো প্রতীক্ষার মাহেন্দ্রক্ষণ। লোকটি আমাদের কাছাকাছি আসতেই শুরু হল, তিন বন্ধু একসাথে গাছের ডাল ঝাঁকুনি ও ঢিল মারার কার্যক্রম। লোকটি ভয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম বলতে বলতে দৌড়াতে দৌড়াতে ভূতের ভয় থেকে নিরাপদ স্থানে চলে গেল। পরদিন সারা গ্রাম এ ভূতের গল্প সকলের মুখে মুখে। লোকটি কোন অবস্থাতে তার থলির মাছ ফেলে যায়নি। আমাদের সময়ে শিক্ষকদের স্বল্প বেতনও কম যোগ্যতাসম্পন্ন ছিল। বর্তমান শিক্ষকদের অনেক বেতন এবং তারা উচ্চ শিক্ষিত। আমাদের মাঝে ছিল সুদৃঢ় ঐক্য, অহেতুক ভূতের ভয় মোটেই কর্তব্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। 

বর্তমান উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকরা সামান্য তেলাপোকা দেখে ভয়ে কিংবা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অনেকটা তাদের বিশাল জ্ঞানের ভাণ্ডারের অর্জন হারিয়ে ফেলে। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যের আন্দোলনের একটি ঘটনা অবতারণা করছি। জানুয়ারি মাসে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহের সমাপনী অনুষ্ঠান ঢাকা ওসমানী মিলায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। সে অনুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক প্রাথমিক শিক্ষক যোগদান করেছিলেন। তখন বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে সর্বপ্রথম প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য আন্দোলন চলেছিল। সে আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে প্রচারপত্র বিলি করেছিলাম। ওসমানী মিলয়নাতনে কয়েক হাজার শিক্ষকের মাঝে বিলি করার দায়ে ডিজি এফ আই-এর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকজন আমাকে গ্রেফতার করে রমনা থানায় নিয়ে যায়। হলের বাইর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল লালবাগ ২নং সরকারি প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক সেলিমুজ্জামানকে। প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সামান্য ভয় মনের মাঝে উদয় হয়নি। আমাকে ধরিয়ে দেয়ার সাথে জড়িত থাকায় খানিকটা অনুতপ্ত হয়েছিলেন মো. দেলোয়ার হোসেন (তখনকার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, ঢাকা)। সে বেতন বৈষম্য আন্দোলনে ননটেইন্ড শিক্ষকদের ২৬০০ টাকা স্কেল থেকে ৩০০০ টাকা, টেইন্ড শিক্ষকেরা ৩০০০ স্কেল থেকে ৩১০০ টাকা, প্রধান শিক্ষকেরা ৩১০০ টাকা থেকে ৩৭০০ টাকা স্কেলে উন্নীত হলো।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পূর্বে বঙ্গভবন ঘেরাও করে গর্ভনর মোনায়েম খাঁর আমলে সর্বপ্রথম প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন স্কেল আদায় হয়েছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশের যেমন সংগ্রামী ইতিহাস ঐতিহ্য আছে। তেমনি প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের সংগ্রামী ইতিহাস, ঐতিহ্য বিদ্যমান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ০১-০৭-৭৩ প্রাথমিক শিক্ষকদের জাতীয়করণ, প্রাথমিক শিক্ষায় দুধ, ছাতু, বিনামূল্যে বই, খাতা, পেন্সিল, কম্বল, ন্যায্য মূল্যে কাপড়, স্কুল ঘর পুনর্নির্মাণের জন্য টিন, অর্থ প্রদান। প্রাথমিক শিক্ষকদের থানার বাইরে বদলী রোধ করার জন্য হাইকোটে রিট, প্রাথমিক শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট, উপজেলার পরিষদের হাত থেকে প্রাথমিক শিক্ষকদের রক্ষার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে ন্যস্তকরণ আদেশ, বর্তমান শিক্ষক নিয়োগ কাঠামো, প্রাথমিক শিক্ষকদের পোষ্য কোটা, ২ বছরের স্থলে ১ বছরের প্রশিক্ষণ, ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষাকে গ্রাম সরকারের অধীনে হস্তান্তর আইন বাতিল, চাকরিচ্যুতির হুমকি তুচ্ছ করে অস্থায়ী খাতের ২০৫ শিক্ষকের চাকরি স্থায়ী করার জন্য নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে দৈনিক বাংলা মোড় হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের ঢল নেমেছিল। তখন প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির আন্দোলনে ২/৩ লক্ষ লোকের গর্জন শাসকগোষ্ঠীসহ জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হতো। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জেনালের এরশাদ ওসমানী উদ্যানে প্রাথমিক শিক্ষকদের মহাসমাবেশে বলেছেন, সমাবেশ-মহাসমাবেশ কাকে বলে? প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আযাদ চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিলেন। তখনকার প্রধান শিক্ষকরা ছিলেন, ম্যাট্রিক, ননম্যাট্রিক, এস.এস.সি, এইচ.এস.সি সর্বাধিক। খুব নগন্য সংখ্যক প্রধান শিক্ষক ছিলেন বি.এ পাm। অথচ নবীন প্রধান শিক্ষক সমিতির নেতা উদীয়মান আমার প্রিয় অনুজ মিজানুর রহমান মিজানের মতো অনেকের ভাবনা, প্রধান শিক্ষকদের আজকের ২য় শ্রেণি যেন হঠাৎ করে সৃষ্টিকর্তা বৃষ্টির মতো ওপর থেকে বর্ষণ করছেন। বর্তমান প্রজেন্মর নেতাদের প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের সংগ্রাম ইতিহাস জানতে হবে। তোষামোদকারী নেতৃত্ব কোনো অবস্থাতে টেকসই হতে পাওে না। প্রাথমিক শিক্ষকদের রোজায় শনিবার স্কুল খোলা, বৃহস্পতিবার আধা ঘণ্টা বেশি ক্লাস। প্রচণ্ড তাপদাহে ৩টা পর্যন্ত শ্রেণির কার্যক্রম চালানোর মতো নিষ্ঠুর অফিস আদেশের সম্পর্কে প্রতিবাদহীন প্রাথমিকের মেরুদণ্ডহীন নেতৃবৃন্দ। বরং তারা ভীত হয়ে দৌড়ে পালিয়েছেন। এভাবে দৌড়ে পালানো ক্ষতিগ্রস্ত করবে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা ও নেতৃত্ব। রাষ্ট্র বা সরকার বিরোধী বক্তব্য থেকে বিরত থাকার আহ্বান রইল। প্রাথমিক শিক্ষার সকল অনিয়ম, বৈষম্য এর বিরুদ্ধে আপনার মতামত দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, জননেত্রী প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসুন

লেখক : মো. সিদ্দিকুর রহমান,  সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ ও সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0050170421600342