অক্সফোর্ডে প্রতিবাদ ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে’ প্রতিরোধ কেন? - দৈনিকশিক্ষা

অক্সফোর্ডে প্রতিবাদ ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে’ প্রতিরোধ কেন?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাংলাদেশে অনধিকার চর্চার উদাহরণ কম নেই। কিন্তু মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর আয়োজিত সংহতি সমাবেশে 'মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশে'র হামলা যেন আগের সব 'রেকর্ড' ম্লান করেছে। ভারতে বিতর্কিত নাগরিক সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে দেশটির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আন্দোলন চলছে, তার সঙ্গে সংহতি জানাতেই এই সমাবেশ ডাকা হয়েছিল। আমার মাথায় আসে না, তাতে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের অসুবিধা কোথায়? যে কোনো নাগরিকের সভা-সমাবেশ করার অধিকার তো সংবিধান স্বীকৃত! শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, হামলাকারী পালের গোদা আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও আল মামুন। মামুন সমকালকে বলেছেন- 'ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আন্দোলন করার এখতিয়ার নুরের নেই' (সমকাল, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৯)। প্রশ্ন হচ্ছে, নুরের আন্দোলন করার এখতিয়ার নির্ধারণের বিষয় আল মামুনকে কে দিয়েছে? মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নাম ব্যবহারে তার নিজের এখতিয়ার রয়েছে কিনা, সেই প্রশ্নই বরং উঠেছে। ওই সংগঠনের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, বুলবুল ও মামুন এখন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কেউ নন। অক্টোবর মাসেই তাদের দু'জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। যাদের নিজের পায়ের তলায় মাটি নেই, তারা অপরের সমাবেশে হামলা করতে আসে কোন খুঁটির জোরে?

যদিও বিলটি পাস হয়েছে লোকসভা ও রাজ্যসভায়, ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন আইন বা 'সিএএ' যে মোটেও দেশটির 'অভ্যন্তরীণ' বিষয় নয়, সেটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই আইনে যেভাবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে যাওয়া হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়কে ভারতে নির্বিচার নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে, তাতে কেবল এই তিন দেশেই সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে এমন নয়। খোদ ভারতেই এই আইন কীভাবে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে, বিশ্ববাসী দেখছে।

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন আইন বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে অস্বস্তিকর। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মের ভিত্তিতে যে দেশ বিভাগ হয়েছিল, বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে তা অস্বীকার করে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের স্লোগান ছিল- 'বাংলার হিন্দু, বাংলার খৃষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান/ আমরা সবাই বাঙালি।' অস্বীকার করা যাবে না, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষা আমরা দেখেছি, পরবর্তীকালে সেটা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। নতুন রাষ্ট্রেও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষ্পেষণের মুখে পড়েছে। কিন্তু এই আইন ভারত এমন সময় পাস করেছে, যখন বাংলাদেশে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, শেখ হাসিনার টানা তিন মেয়াদে সংখ্যালঘু নির্যাতন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।

এখন প্রতিবেশী দেশের এই আইন এ দেশে নতুন করে সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংগঠনটি বলছে- 'এর ফলে অধিকতর নিরাপত্তার আশায় বাংলাদেশে বাস করা সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগে উৎসাহিত হতে পারে। একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণকে নিরুৎসাহিত করতে পারে।'

কেবল বাংলাদেশে উদ্বেগ নয়, ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের সমালোচনা ও প্রতিবাদ বিশ্বজুড়েই হচ্ছে। এই আইন স্পষ্টই বর্ণবাদী। যে কারণে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা ইতোমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বিশ্বের খ্যাতিমান সব বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের সঙ্গে সংহতি সমাবেশ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক সময় নিজেকে 'প্রাচ্যের অক্সফোর্ড' আখ্যা দিয়ে থাকে। অথচ যুক্তরাজ্যে অবস্থিত আসল অক্সফোর্ডে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে প্রতিবাদ ও সংহতি সমাবেশ হয়েছে। সমাবেশ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও। আমিনুল ইসলাম বুলবুল বা আল মামুনের 'হেডম' কুলাবে সেখানে গিয়ে বাধা দেওয়ার?

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের তথাকথিত নেতারা মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা করেছেন, তা নিছক আইনশৃঙ্খলাবিরোধী অকাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত অবিলম্বে এই হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত হবে ফৌজদারি অপরাধে এদের আইনের আওতায় নেওয়া। এরা দড়ি ছেঁড়া ষাঁড়ের মতো যেখানে-সেখানে গুঁতা দিয়ে বেড়াবে, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য তা কল্যাণকর নয়। এদের লাগাম পরাতেই হবে।

হতে পারে, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ সাংগঠনিকভাবে বা বুলবুল-মামুন ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমতাসীন কোনো মহলের আশীর্বাদপুষ্ট। কিন্তু সংহতি সমাবেশে হামলার মতো কর্মকাণ্ড শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের জন্যই কীভাবে বিপাক ডেকে আনে, বুয়েটের অঘটনে আমরা দেখেছি। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তির সমালোচনা করেছিল বলে বুয়েট ছাত্রলীগের স্বঘোষিত ভাবমূর্তি রক্ষকরা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বঘোষিত এখতিয়ারওয়ালাদের এখনই রুখতে না পারলে এরাও একই অঘটন ঘটাতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংহতি সমাবেশে হামলা সরকারের পররাষ্ট্রনীতি ও আঞ্চলিক কৌশলেরও বিরোধী। ভিপি নুরুল হক নুরের অবস্থান বরং সরকার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের পক্ষে। ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী নিয়ে যেখানে বাংলাদেশ স্পষ্টতই কড়া অবস্থান গ্রহণ করেছে; মাত্র এক সপ্তাহে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং যৌথ নদী কমিশনের প্রতিনিধি দল ভারত সফর স্থগিত করেছেন; সেখানে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ থেকে খেদিয়ে দেওয়া কিছু তরুণ বাংলাদেশে বসে ভারতের 'অভ্যন্তরীণ' স্বার্থ রক্ষা করতে চাইছে? এদের তো দেখি কাণ্ডজ্ঞানেরও গুরুতর ঘাটতি রয়েছে!

শেখ রোকন : লেখক ও গবেষক।

ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032460689544678