বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার ধানসাগর নলবুনিয়া আলিম মাদ্রাসার বিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক এ রহমান খান। নিয়োগের সময় শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাসের সনদ জমা দেন তিনি। পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) অনুসন্ধানে ওই শিক্ষকের জমা দেয়া সনদ ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে বেতন-ভাতা হিসেবে দেয়া ১৬ লাখ ২০ হাজার ২৮৯ টাকা ওই শিক্ষকের কাছ থেকে ফেরত নেয়ার সুপারিশ করেছে ডিআইএ।
একই ঘটনা ঘটেছে নোয়াখালীর হাতিয়া ডিগ্রি কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক শাহিদা আক্তার রুমির ক্ষেত্রেও। নিয়োগকালে তিনি ভুয়া নিবন্ধন সনদ জমা দিয়েছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে ডিআইএ। এজন্য তার কাছ থেকেও ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৯৭৫ টাকা ফেরত নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৪ জুন পর্যন্ত এ ধরনের ৭৬০ জন ভুয়া সনদধারী শিক্ষকের নাম উঠে এসেছে ডিআইয়ের অনুসন্ধানে। এসব শিক্ষকের কাছে আদায়যোগ্য ২৯ কোটি ৪৩ লাখ ১৫ হাজার ৭৩২ টাকা ফেরত নেয়ার জন্য সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে ডিআইএ।
এ প্রসঙ্গে ডিআইএ যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, ভুয়া সনদের বিষয়ে ডিআইএর তদন্ত কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। নিয়মিতভাবেই এ ধরনের তদন্ত পরিচালনা করা হচ্ছে। এ প্রতিবেদনে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে এখন পর্যন্ত যেসব ভুয়া সনদ চিহ্নিত হয়েছে, তাদের তালিকা ও আদায়যোগ্য টাকার পরিমাণের তথ্য দেয়া হয়েছে। এ তালিকার বাইরেও আরো ৮১টি ভুয়া সনদের তথ্য পাওয়া গেছে, যা চূড়ান্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ডিআইএর ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত হওয়া বেশির ভাগ সনদই শিক্ষক নিবন্ধনের। ৭৬০ জন শিক্ষকের মধ্যে ৫১১ জনের শিক্ষক নিবন্ধন সনদ ভুয়া। কম্পিউটার সনদ ভুয়া পাওয়া গেছে ১৯৩ জনের। এর বাইরে শরীরচর্চা, গ্রন্থাগারিকসহ অন্যান্য ক্ষেত্রের মোট ৫৬টি ভুয়া সনদ চিহ্নিত হয়েছে।
বিভাগভিত্তিক হিসাবে ভুয়া সনদধারী শিক্ষকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি রাজশাহী বিভাগে। ৭৬০ জন ভুয়া সনদধারীর মধ্যে রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রয়েছেন ২৬৯ জন। ভুয়া সনদধারী এসব শিক্ষকের কাছে পাওনা ৯ কোটি ৯২ লাখ ৭২ হাজার ৩৯৪ টাকা। সমানসংখ্যক ভুয়া সনদধারী পাওয়া গেছে ঢাকা বিভাগে। এখানে ভুয়া সনদধারী শিক্ষকের সংখ্যা ২৬৯ জন। এসব শিক্ষকের কাছ থেকে আদায়যোগ্য অর্থের পরিমাণ ১০ কোটি ৬৬ লাখ ৫২ হাজার ২৮৯ টাকা। খুলনা ও বরিশাল বিভাগ মিলে ভুয়া সনদধারীর সংখ্যা ১৭৬, তাদের কাছ থেকে আদায়যোগ্য অর্থের পরিমাণ ৭ কোটি ৩৯ লাখ ৭২ হাজার ৬২ টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে ভুয়া সনদধারী শিক্ষক চিহ্নিত হয়েছেন ২৮ জন, যাদের কাছে সরকারের পাওনা ১ কোটি ৪৪ লাখ ১৮ হাজার ৯৮৭ টাকা।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভুয়া বা জাল সনদ ব্যবহার করে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ভুয়া সনদ দিয়ে শিক্ষকতা পেশায় আসা এটা এক ধরনের গর্হিত কাজ। শিক্ষকদের কাছে নীতি-নৈতিকতা শেখার কথা ছাত্রছাত্রীদের। তারা নিজেরাই যদি অনৈতিক পন্থায় প্রতারণার মাধ্যমে এ পেশায় নিয়োগ পান, তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের কাছে কী নৈতিকতা শিখবে? আমরা যে বলছি, শিক্ষার মান কমছে; এ ধরনের প্রতারক শিক্ষক পদে নিয়োগ পেলে মান বাড়বে কীভাবে। আমাদের আরেকটি বিষয় দেখতে হবে, নিয়োগের সময়ে সনদ ও যোগ্যতা যাচাই করার কথা। যে ব্যক্তি ভুয়া সনদ দিয়ে চাকরি পান, তিনি তো কখনো যোগ্য শিক্ষক হতে পারেন না। তাহলে ভুয়া সনদধারীদের কারা নিয়োগ দিল? অনেক সময় অর্থের বিনিময়ে এসব অযোগ্য লোককে নিয়োগ দেয়া হয়। তাই নিয়োগকর্তারাও অভিযোগের বাইরে নন।
এদিকে নিয়োগ প্রক্রিয়ার দুর্বলতার কারণেই এসব ব্যক্তি ভুয়া সনদ ব্যবহার করে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের সুযোগ পাচ্ছেন বলে মনে করছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নিয়োগের আগেই সনদগুলো যাচাই-বাছাই করে নিলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতো না। এ বিষয়ে ডিআইএ উপপরিচালক সৈয়দ জাফর আলী বলেন, সনদ যাচাই করে নিয়োগ দেয়া হলে একদিকে যেমন ভুয়া সনদের মতো এ ধরনের সমস্যা থাকবে না। অন্যদিকে সরকারি অর্থেরও অপচয় বন্ধ হবে।