অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে জটিলতায় দুই মন্ত্রণালয় - দৈনিকশিক্ষা

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে জটিলতায় দুই মন্ত্রণালয়

রাকিব উদ্দিন |

শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ বাধ্যতামূলক করা হলেও এখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ‘প্রাথমিক শিক্ষা’ হবে নাকি ‘বেসিক এডুকেশন’ হবে তা নির্ধারণে জটিলতায় পড়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, বেসিক এডুকেশন হবে কিনা সেটা ভেবে দেখতে হবে এবং প্রাথমিক শিক্ষা ৮ম শ্রেণিতে উন্নীত করলে যোগ্য শিক্ষকের অভাব হবে। কিন্তু গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, ৮ম শ্রেণিতে উন্নীত করলে যোগ্য শিক্ষক ও অবকাঠামো সংকট হবে না। আর বেসিক এডুকেশনেরও (মৌলিক শিক্ষা) প্রয়োজন নেই।

অথচ দুই মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা উন্নীত করতে হলে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন সংশোধনের প্রয়োজন হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কিছু আইন, বিধি, প্রজ্ঞাপন সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে।

এছাড়াও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা স্তর করার জন্য সব বিষয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিচালনা করবে কিনা তা শিক্ষানীতিতে উল্লেখ নেই। কিন্তু বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা দুই মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির বলেন, ‘২০১৮ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার আবশ্যকতা রয়েছে। কিন্তু এখন প্রাথমিক শিক্ষা ও বেসিক এডুকেশনের কথা বলে সময় ক্ষেপণ করা হচ্ছে। আসলে দুর্বল আমলাতন্ত্রের কারণেই এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কারণ বেসিক এডুকেশন তো প্রাথমিক শিক্ষার মধ্যেই রয়েছে। এটা নিয়ে এখন আলোচনা কেন?’

প্রাথমিক স্তরকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করলে যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষকের অভাব হবে বলে মনে করছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা বলেন, যেসব বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত চালু আছে সেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিভাজন এবং পরিচালনা কিভাবে হবে তা সুনির্দিষ্ট করা জটিল ব্যাপার।

‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে প্রাথমিক শিক্ষা স্তর ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কমিটির এক সভায় (গত ১৬ আগস্ট) এসব বিষয় উঠে আসে। পরে ওই সভার কার্যক্রম সংবলিত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন কমিটির আহ্বায়ক কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর।

এর আগে গত ১৬ মে কীভাবে প্রস্তুতি নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করা যায়, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঠিক করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের সচিব মো. আলমগীরের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন দুই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

ওই সভায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরর (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক এসএম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, প্রাথমিক শিক্ষাকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার বড় সমস্যা হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে প্রয়োজনীয় ক্লাসরুম ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব। সেসব বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত চালু আছে সেগুলোকে কীভাবে আলাদা করা হবে সে বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন।

বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে শিক্ষক কাঠামো আছে বা তারা যে শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে এ পেশায় যোগদান করেছেন তাদের দিয়ে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস চালানো সম্ভব কিনা তা পর্যালোচনা করা দরকার উল্লেখ করে মাউশি মহাপরিচালক বলেন, প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা ‘প্রাথমিক শিক্ষা’ হবে নাকি ‘বেসিক এডুকেশন’ হবে তাও নিশ্চিত করা দরকার।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) মনে করছে, প্রাথমিক শিক্ষা বা বেসিক এডুকেশন যাই হোক না কেন আগে শিক্ষার স্তর ঠিক করতে হবে। সেটা প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হবে, নাকি বর্তমানে প্রচলিত স্তর থাকবে সেটা পরিষ্কার করতে হবে। কারণ শিক্ষার স্তরের ওপর ভিত্তি করেই কারিকুলাম তৈরি হয়। শিক্ষার স্তরের সঙ্গে কারিকুলামের এলাইনমেন্ট (একই সরল রেখায় বিন্যাস) করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘বেসিক এডুকেশন নাকি প্রাথমিক শিক্ষা- এসব বিষয়ে বিতর্ক করতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে। শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন পিছিয়ে যাচ্ছে।’

গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি যোগ্য শিক্ষকের অভাব হবে না : শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার পরিবর্তে বেসিক এডুকেশন বলার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পুলক রঞ্জন সাহা। তার দাবি প্রাথমিক স্তর অষ্টম পর্যন্ত সম্প্রসারিত করলে যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক বা অবকাঠামোর তেমন অসুবিধা হবে না।

প্রাথমিক স্তর ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করা যাবে দাবি করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) সঞ্জয় কুমার চৌধুরী বলেন, ‘প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের প্যাডাগোজিক্যাল (শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত) প্রশিক্ষণ দিতে হবে।’

বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভালোমানের শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে- দাবি করে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্যাডার সার্ভিসে শূন্য পদের অভাবে বিসিএসে উত্তীর্ণদের (নন-ক্যাডার) মধ্যে থেকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।’

কিন্তু শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নন-ক্যাডারে সীমিত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শূন্য পদ আগামী ৫০ বছরেও পূরণ করা সম্ভব হবে না। কারণ একটি বিসিএস পরীক্ষা এক বছরে নেয়া সম্ভব হলে হয়তো ৫০০ থেকে এক হাজার শিক্ষক নিয়োগ নিয়োগ দেয়া যাবে। অথচ বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন ৫-৭ জন প্রাথমিক শিক্ষক অবসরে যাচ্ছেন।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান গত ৬ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে জানান, বর্তমানে দেশের ২১ হাজার প্রধান শিক্ষকের পদ ও ৩২ হাজার সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছ। এর মধ্যে ৮৯৮ জনকে (বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও পদের অভাবে ক্যাডার পদে নিয়োগ পায়নি) প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে সুপারিশ করেছিল পিএসসি। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময়ে এদের পুলিশ ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করতে পারেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

১৬ আগস্টের সভায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (কারিগরি) এনামুল হক বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা স্তর ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হলে কিছু বিদ্যালয়ে অবকাঠামোগত সমস্যা হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা ৮ম শ্রেণিতে উন্নীত করলে বিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পাঠদান সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনগুলো পরিবর্তন করতে হবে- উল্লেখ করে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, ‘নতুবা নতুন বিদ্যালয় স্থাপন বা পাঠদানের অনুমতি প্রদানে জটিলতা থেকে যাবে।’

কমিটির প্রধান মো. আলমগীর বলেন, ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে উভয় মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। যে মন্ত্রণালয় কর্তৃক যে বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালিত হচ্ছে এর প্রশাসনিক ও আর্থিক বিষয়, যেমন বিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি, পাঠদানের স্বীকৃতি, ছাত্র ভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের বেতন ভাতাদি প্রদান, বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার ইত্যাদি ওই মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত কারিকুলাম তৈরি ও বই ছাপানো (এনসিটিবির মাধ্যমে) এবং সরবরাহ, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল প্রকাশ ইত্যাদি উভয় মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বিদ্যালয়ের জন্যই প্রাথমিক ও গণশিক্ষালয় করে আসছে। ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা উন্নীত করতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন সংশোধনের প্রয়োজন হবে বলেও জানান কমিটির প্রধান।

দেশে প্রায় ৬৩ হাজার ৮৬৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যালয় ৩৭ হাজার ৬৭২টি ও ২০১৩ সালে জাতীয়রণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৫ হাজার ২৪০টি এবং পরীক্ষণ বিদ্যালয় ৫৫টি। এছাড়া বিদ্যালয়বিহীন গ্রামগুলোতে একটি করে মোট এক হাজার ৫০০টি নতুন বিদ্যালয় নির্মাণ করা হচ্ছে, যার বেশিরভাগই ইতোমধ্যে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করেছে। এগুলোসহ মোট বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৬৪ হাজার।

দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা - dainik shiksha চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? - dainik shiksha স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার - dainik shiksha কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036659240722656