প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানতে অ্যাসেম্বলি করানো বাধ্যতামূলক হলেও ঠাকুরগাঁওয়ের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অ্যাসেম্বলি ক্লাস করানো হয় না। বিশেষ করে মাদরাসা, কিন্ডারগার্টেন এবং মাধ্যমিক স্কুলগুলো অ্যাসেম্বলি ক্লাস করতে তেমন আগ্রহী নয়।
জানা গেছে, হরিপুর উপজেলার গ্রাম অঞ্চলের কিছু স্কুলেও বেশ অনিয়মিত অ্যাসেম্বলি ক্লাস হয়। এতে শিক্ষার্থীদের দেশাত্মবোধ কমে যাচ্ছে আর জাতীয় সংগীতের মর্মবাণী না বোঝার কারণে সচেতন মূল্যবোধ কমে আসছে বলে মন্তব্য করেছে সচেতন মহল। তাই এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নজরদারি বাড়ানোসহ নিয়মিত পরিদর্শন করা দরকার বলে মনে করেন তাঁরা।
উপজেলার চৌরঙ্গী বাজারের একজন চাকরিজীবী জানান, ‘এ বছর আমার মেয়েকে প্রথম স্কুলে দিয়েছি। আসা যাওয়ার সুবিধার জন্য তাকে কাছের একটি কেজি স্কুলে দিয়েছি। আমি ৭-৮ দিন ধরে ঐ স্কুলে গিয়ে দেখলাম কোনোদিন অ্যাসেম্বলি ক্লাস হয়নি। এমন কি জাতীয় সংগীত গাওয়ানো হয়নি। আমি বিষয়টি নিয়ে একজন অভিভাবকের সঙ্গে পরামর্শ করলে তিনি বললেন, হয়তো খুব সকাল বেলায় ক্লাস শুরু হয় আর সকালে বর্তমানে একটু ঠাণ্ডা থাকে তাই হয়তো অ্যাসেম্বলি ক্লাস হচ্ছে না। আর সকালে না হোক ছুটির সময়ে তো অ্যাসেম্বলি ক্লাস করানো যেতে পারে। সেটাও হচ্ছে না।’
পরে এ বিষয়ে স্কুলের একজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, ‘এখন বেশ ঠাণ্ডা পড়ে। তাই খুব সকালে জাতীয় সংগীত গাওয়াতে অসুবিধা হয় আর কী।’
কাঠালডাঙ্গী এলাকার শিক্ষাবিদ আফতাবউদ্দিন (রেজা) দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, ‘আমার জীবনে বেশিরভাগ সময় কেটেছে মাদরাসায়। আমি কোনোদিন অ্যাসেম্বলি ক্লাস মিস করিনি, কারণ দলগতভাবে জাতীয় সংগীত শুনতে কী যে ভালো লাগে সেটা বোঝানো যাবে না। আর দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে অনেক স্কুলে অ্যাসেম্বলি ক্লাস নিতে শিক্ষকরা তেমন আগ্রহী নন। তারা খারাপ আবহাওয়ার দোহাই দেন। এতে শিক্ষার্থীরা শুধু পাঠ্যবইয়ের গৎবাঁধা পড়া নিয়ে থাকবে। তাদের ভেতরে কোনো দেশাত্মবোধের চেতনা গড়ে উঠবে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার (সাবেক) নগেন কুমার পাল দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘হরিপুর উপজেলায় অনেক কেজি স্কুল আছে। তবে নিয়মিত অ্যাসেম্বলি ক্লাস হয় কিনা সন্দেহ। কারণ তাদের অ্যাসেম্বলি ক্লাস করার মতো জায়গা নেই। তারা অল্প জমিতে বা কারো বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে স্কুল করেছে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ক্লাস নির্ভর হওয়ায় তাদের অ্যাসেম্বলি করানোর প্রস্তুতি নেই। আবার অনেকেই অ্যাসেম্বলি করছে কিন্তু সেটা মোটেও মানসম্মত নয়। ৪র্থ এবং ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে জাতীয় সংগীত এবং শপথ বাক্য পাঠ করাচ্ছে। এতে অনেক সময় জাতীয় সংগীতের সুর বা কথা বিকৃত হয়ে পড়ে। এটা আরও মারাত্মক অপরাধ। তাই এ বিষয়ে খুবই গুরুত্ব দেয়া দরকার।’
এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হরিপুর উপজেলার বেশিরভাগ কেজি, মাধ্যমিক স্কুল আর মাদরাসাগুলোতে নিয়মিত অ্যাসেম্বলি ক্লাস হচ্ছে না। আবার অনেক স্কুলে অ্যাসেম্বলি করানোর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসর প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা জয়নুল হক দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, ‘শিশুবেলা থেকে শিক্ষার্থীদের দেশাত্ববোধক চেতনা বিকাশে অ্যাসেম্বলি ক্লাসের কোনো বিকল্প নেই। জাতীয় সংগীতের মর্মবাণী যে কোনো মানুষকে আবেগী করে আর শপথ বাক্য মানুষের জীবনকে পথ চালানোয় সহায়তা করে। সেখানে যদি স্কুলে অ্যাসেম্বলি না হয় সেটা খুবই দুঃখজনক। আমার জানা মতে, অনেক কেজি স্কুল, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদরাসায় বিভিন্ন অজুহাতে অনিয়মিত অ্যাসেম্বলি ক্লাস হয়। আর এখন যে কেজি স্কুলগুলো গড়ে উঠেছে সেখানেও নানান কারণে অ্যাসেম্বলি ক্লাস হচ্ছে না। এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে কঠোর ভূমিকা নেয়া দরকার।’
অন্যদিকে, হরিপুর মোসলেমউদ্দিন ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘স্কুল জীবনে অ্যাসেম্বলির প্রত্যেকটি শব্দ এখনো আমাদের মনে গেঁথে আছে। আর জাতীয় সংগীতের যে বাণী সেটা কখনো মলিন হবার নয়। আমার মতে, অ্যাসেম্বলি ক্লাসই স্কুল জীবনের মূল। এখানে শৃঙ্খলা, অনুশাসন এবং দেশপ্রেম শেখা যায়। তাছাড়া বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে কিছু কেজি স্কুল চালাচ্ছে। তারা অ্যাসেম্বলি ক্লাস করছে কোথায়? আর গ্রামের স্কুলগুলোর দিকে আরও নজরদারি বাড়ানো দরকার।’
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আজিজার রহমান বলেন, ‘অ্যাসেম্বলি করানো বাধ্যতামূলক কেউ সেটা না করলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করবে। আর সরকার এখন স্কুলে বার্ষিক বরাদ্দ দিয়ে থাকে। তাছাড়া আমাদের নিদের্শনা থাকে, সে বরাদ্দ থেকে হারমোনিয়াম, তবলা বা সাউন্ড সিস্টেম কিনে সুন্দরভাবে জাতীয় সংগীত বাজানোর।’
আর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এস আর ফারুক দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘অ্যাসেম্বলি ক্লাস বাধ্যতামূলক। এখানে ঝড়, বৃষ্টি, রোদ, শীত কোন অজুহাত চলবে না। স্কুল হলেই অ্যাসেম্বলি ক্লাস হতে হবে। আমরা এ বিষয়ে আরও নজরদারি বাড়াবো। কোনো স্কুল অ্যাসেম্বলি ক্লাস না করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’