শিশুরা আগামী প্রজন্মের কর্ণধার। এ মহাবাক্যটি সকলের কণ্ঠে একাকার। অথচ আমরা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে করণীয় সম্পর্কে কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাবছি? শিশুদের নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, অভিভাবক ও শিক্ষকদের দায় কি যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে? শিশু শিক্ষা আজ বৈষম্যের বেড়াজালে ঝুলে আছে। শিশু শিক্ষার মতো এত বৈষম্য বড়দের শিক্ষা ব্যবস্থায় তেমন নেই। শিশুদের জন্যে ১১ ধরনের শিক্ষা। এ বছরের শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আজকের শিশু আনবে আলো : বিশ্বটাকে রাখবে ভালো’। শিশু নিজে আলোকিত হয়ে এ দেশ তথা বিশ্বটাকে কীভাবে ভালো রাখতে পারা যায় তা সকলের মাঝে ভাবনা থাকতে হবে। ভ্রান্ত ধারণা পরিহার করে এ বিশ্বকে শিশুদের স্বর্গরাজ্যে রূপান্তরিত করার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পরেও বৈষম্যে জর্জরিত আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। ছোট্ট সোনামনিদের শিক্ষা ব্যবস্থা এ থেকে মুক্ত নয়। বৈষম্যের করালগ্রাসে তারা বেড়ে উঠছে। খেলাধুলার মাঝে শিশু শিক্ষা এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মাঝে আছে বলে দৃশ্যমান নয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ সংকুচিত হতে চলছে। প্রভাবশালীদের দখল বা নানা কাজে ব্যবহার, অবকাঠামো উন্নয়নের নামে হারিয়ে যেতে বসেছে খেলাধুলার সুযোগ সুবিধা। শিশুদের প্রতিদিনের রুটিনে ১টা পিরিয়ড খেলাধুলা, বিতর্ক অনুষ্ঠান, আঁকাজোকা, গল্প, কবিতা পাঠসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থাকার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্ডারগার্টেন স্কুল খুপড়ি ঘরে মাঠবিহীন শিক্ষা বন্ধ করতে হবে।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা শিশুর জ্ঞান অর্জনের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয় পরীক্ষা ব্যবস্থার ওপর। বিশেষ করে শিশু যখন জ্ঞানের ভাণ্ডারে ভরপুর না হয়ে উপরে ক্লাসে বড় বড় পাস নিয়ে থাকে। তখন শিক্ষাবিদসহ দেশি-বিদেশি সকল মহলের আঙ্গুল থাকে হতভাগা শিক্ষকের দিকে। নিজেদের দায় বেমালুম ভুলে সকল দোষ শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দেয়। অধিকাংশ বেসরকারি বিদ্যালয় বিশেষ করে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো শিশুর জ্ঞান অর্জনে মেধা বিকাশের অন্তরায়। তার অন্যতম কারণ ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি, প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক। এক্ষেত্রে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দায়হীন উদাসীন হয়ে শুধু দেখছে তো দেখছেই। ইদানিং মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কিন্ডারগার্টেনে বইয়ের বোঝা শিশুর মেধা বিনাশ করে- এ বক্তব্য রেখেছেন। অথচ তাঁর মন্ত্রণালয়ের এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। শিশুদের বইয়ের বোঝা দূর করার কার্যকর সময় অতি সন্নিকটে। কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোকে যারা শিশুর মেধাবিনাশকারী বই শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেবে তাদের প্রথমত, বিনামূল্যের বই বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে। তৃতীয়ত, এ বিষয়ে সারাদেশে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান চালাতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ হ্রাস করে হলেও নিবন্ধিত বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের ২০২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ছোট্ট সোনামনিদের খেলাধুলা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও নিজ পরিবেশকে জানার মাধ্যমে এ প্রত্যাশা হোক গোটা জাতির। শিক্ষার নামে মহাপণ্ডিত বানানোর জন্য চার বছর থেকে বই ও খাতার বোঝা চাপানো শিশু নির্যাতন ব্যতিরেকে কিছুই না। শিক্ষকতা থেকে অবসর হওয়ার পর সংবাদপত্রের জগতের সুবাদে আমাকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গমন করতে হয়। কিন্ডারগার্টেনে প্লে, নার্সারি, কেজি, জুনিয়র ওয়ান, সিনিয়র ওয়ান, পরবর্তী সময়ে ওয়ান ক্লাস সৃষ্টি করে মেধা বিনাশ করছে। শিশুকে আনন্দ বঞ্চিত করে খেলা, আঁকাজোকা, ছড়া, কবিতা, গান, আবৃত্তিসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বিলীন করে পড়ানো, শিশু মনোবিজ্ঞান পরিপন্থি। কঠিন কঠিন ইংরেজি, আরবি শব্দ, বাক্য, যা ৪র্থ শ্রেণি থেকে উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির পড়া। ভাবতে অবাক লাগে ১ম শ্রেণি থেকে বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামারের সংজ্ঞা মুখস্ত করানো হয়। আর শিশু তোতা পাখির মতো না বুঝে মুখস্থ করে থাকে। পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বই ছাড়া ৮-১০টি বইয়ের বোঝা তাদের বহন করতে হয়। জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে শিশুর ওপর নেমে আসে না বুঝে উপরের শ্রেণির পড়া মুখস্ত করার নির্যাতন। অনেক অশিক্ষিত অভিভাবকের ভাবনা বেশি বই পড়লে শিশুকালেই সে বড় পণ্ডিত হবে। বিষয়টি অনেকটা বেশি খেলে যেমন বমি বা পেট খারাপ হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনার মতো। আনন্দ মুখর পরিবেশে জ্ঞান নির্ভর পড়ার মাধ্যমে শিশুর মেধা বিকাশ ঘটবে। এটা হওয়া উচিত। এতে বড় বড় জিপিএ-৫ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করবে না।
লেখাপড়ার প্রধান উদ্দেশ্য হবে জ্ঞান অর্জন। হাতুড়ে মার্কা পরীক্ষা ব্যবস্থার মৃত্যু ঘটুক। আদর্শ জ্ঞাননির্ভর মূল্যায়ন ব্যবস্থা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিশুদেরও শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটবে। আগামী প্রজন্মের শিশুদের মেধা বিনাশকারী বইসহ সকল কার্যক্রম বন্ধ করার দায়িত্ব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সকল শিক্ষকদের। দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতায় শিক্ষকদের শিক্ষকতা ও মন্ত্রী, সচিব, কর্মকর্তাদের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অব্যাহতি দেয়া হোক। আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যত সোনামনিদের স্বর্গীয় ভবিষ্যত নষ্ট করার কোনো অধিকার কারো নেই।
প্রতিটি বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা শিগগির করা প্রয়োজন। মেধাবিনাশকারী বই পড়ানো নিষিদ্ধ করার আর সময়ক্ষেপণ নয়। শিশুর অধিকার মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করুন। কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ে শিশুর উপযোগী ছড়া, কবিতা ও গল্পের বইয়ের বাইরে সকল বই বন্ধ করতে হবে। সকল শিক্ষকসহ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ হোক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি সকল শিশু শিক্ষালয়ের বই, খাতার বোঝা কমানো। আর বক্তব্য দিয়ে সময়ক্ষেপণ নয়। জানুয়ারি ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সকল শিশুর জন্য অভিন্ন বই, কর্মঘণ্টা ও আদর্শ মূল্যায়ন ব্যবস্থা কার্যকর করার অঙ্গীকার হোক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। শিশু শিক্ষা নিয়ে প্রকৃত ভালবাসা উদয় হোক সকলের মাঝে।
মো. সিদ্দিকুর রহমান : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।