আঞ্চলিক উন্নয়নে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব | মতামত নিউজ

আঞ্চলিক উন্নয়নে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব

দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস একশ বছরের। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯২১ সালের ১ জুলাই তৎকালীন পূর্ববঙ্গে, বর্তমান বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস একশ বছরের। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯২১ সালের ১ জুলাই তৎকালীন পূর্ববঙ্গে, বর্তমান বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয় এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, ১৯১২ সালের নাথান কমিশনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ২৬ বছর পর ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীন হয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৩ সালে উত্তরবঙ্গে রাজশাহী, ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম এবং ১৯৭০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে দেশে ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর এ চারটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। তাই এ চারটি স্বায়ত্তশাসিত এবং ৪২টি বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান যা পরিচালনার জন্য সরকার অর্থায়ন করে থাকে।

৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আটটি ঢাকা শহরে, একটি ঢাকা জেলার সাভারে এবং ৩৭টি স্থানীয় জেলা পর্যায়ে অবস্থিত। সরকার আরও ১২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়েছে।

অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটিই ঢাকা শহরের বাইরে জেলা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করবে। বর্তমান সরকার দেশের প্রতিটি জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

সে অনুযায়ী সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অঙ্গীকার পূরণে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা দান, গবেষণা জ্ঞানের সৃজন, উৎকর্ষ সাধন ও বিতরণের ব্যবস্থা, উদ্ভাবন ছাড়াও ব্যক্তির ও আঞ্চলিক উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

অঞ্চলভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, যোগাযোগ, চাকরির সুযোগ, কর্মসংস্থানসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। নিজের এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার ফলে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে সহজেই। উচ্চশিক্ষা গ্রহণে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা আরও বেশি উৎসাহী হচ্ছে এবং এলাকায় থেকেই পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে জেলা কোটা থাকায় স্থানীয় শিক্ষার্থীরা ভর্তির ক্ষেত্রে বেশি সুযোগ পাচ্ছে।

এখন প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলছে। এমনকি কোনোটিতে আবার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত হয়েছে। বর্তমানে ২৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ হাজার ৭০৭ কোটি ১৪ লাখ টাকার উন্নয়ন কাজ চলমান আছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রথম বাজেট হয়। তখন মোট বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকার এবং শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৪৩ কোটি টাকা। বর্তমানে ২০২০-২১ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৬ হাজার ৪০১ কোটি টাকা।

৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বাজেট বরাদ্দ ৮ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব বাজেট ৫ হাজার ৪৫৪ কোটি ১২ লাখ এবং উন্নয়ন বাজেট ৩ হাজার ৩১ কোটি টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার উন্নয়নের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ব্যাপক প্রভাব রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সেসব এলাকায় অধ্যয়নের জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থী অবস্থান করছে। সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও সেখানে অবস্থান করেন।

স্থানীয় পর্যায়ে অবস্থানের কারণে তাদের আবাসন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য উপার্জনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করে থাকেন। এর ফলে আঞ্চলিক অর্থপ্রবাহে বহুগুণ গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় লোকজনের চাকরির ক্ষেত্রেও সুযোগ বেড়েছে। চাকরির ক্ষেত্রে স্থানীয় চাকরি প্রার্থীরা কিছুটা বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকেন। নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আবেদনের সংখ্যাও হয় বেশি।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, আবাসনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই চাহিদা বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এসব প্রতিষ্ঠানের গুণগত মানও দিন দিন বাড়ছে। চাকরির পাশাপাশি কর্মসংস্থানে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে বা স্থানীয় পর্যায়ে চায়ের দোকান, মুদিখানা, ফটোকপির দোকান, হোটেলসহ নানা ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসা গড়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে তারা ভালোভাবে সংসার নির্বাহ করছে। স্থানীয় লোকজনের জীবনমান আগের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে প্রায় ৭২ বছর বয়স্ক একজন চা দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সেখানে ব্যবসা করছেন। তার আয়-রোজগারও বেশ ভালো। চা বিক্রি করে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা আয় করেন।

এতে তার সংসার খুব ভালো চলছে বলে তিনি জানান। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে ছোটখাটো ব্যবসা করলেও ভালো করতে পারেননি। যোগাযোগেও ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে আশপাশের রাস্তাঘাট সংস্কার ও নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ হয়ে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতীয় দিবস ছাড়াও বিভিন্ন সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। যেমন-বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন মেলার আয়োজন, কবিতা আবৃত্তি, র‌্যাগ ডে পালন, গানের অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, কুইজ প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুস্থধারার সংস্কৃতির প্রভাব পড়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সংস্কৃতির বিনিময় ঘটছে। স্থানীয় পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন শিক্ষার্থীও অন্য আরেকটি জেলায় অধ্যয়ন করার সুযোগ পাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন জেলার সঙ্গে সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটছে এবং সার্বজনীনতার একটি আবহ তৈরি হচ্ছে।

বিভিন্ন জেলার মানুষ এক ছাতার নিচে চলে আসছে। শিক্ষায় বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় শিক্ষার্থীকে এখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে কমই দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। আর এর ফলে শিক্ষার্থীর পাশাপাশি তাদের অভিভাবকদেরও কষ্ট অনেকটা লাঘব হয়েছে।

লেখক : মো. বাবুল হোসেন, জনসংযোগ কর্মকর্তা, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়