আন্দোলনরত শিক্ষকদের বাড়ি পাঠানোর পথ খুঁজছে সরকার - দৈনিকশিক্ষা

আন্দোলনরত শিক্ষকদের বাড়ি পাঠানোর পথ খুঁজছে সরকার

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য |

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে অনশনরত নন-এমপিও শিক্ষকদের বাড়ি পাঠানোর পথ খুঁজছে সরকার। বিভিন্ন চিঠি চালাচালির কৌশল অবলম্বন করে এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে কথাটি বলে রাস্তায় নামা শিক্ষকদের আশ্বস্ত করতে চাইছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এসব উদ্যোগে আন্দোলনরত শিক্ষক-কর্মচারীরা ভরসা রাখতে পারছেন না। এ জন্য তারাও রাজপথ না ছেড়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ৫ম দিনের মতো অনশন কর্মসূচি চালিয়েছেন। উপবাস থাকার কারণে বহু শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

এরকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের শরিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল শিক্ষক আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করায় শিক্ষাঙ্গনে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে ক্লাসরুমে পাঠদানে ব্যাঘাত ঘটছে। শিক্ষকরা বলেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলে দিক, আগামী এতদিনের মধ্যে শিক্ষক কর্মচারীদের এমপিওভুক্ত করা হবে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা না দিয়ে শুধু বলছে অর্থ মন্ত্রণালয় যত তাড়াতাড়ি টাকা দেবে তত তাড়াতাড়ি নীতিমালার ভিত্তিতে অনশনরত শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা হবে। কিন্তু শিক্ষকরা তাতেও আপত্তি জানিয়ে বলেছেন, সব প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত না করলে অনশন কর্মসূচির ইতি টানবেন না।

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) মো. জাবেদ আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেছেন, শিক্ষকদের কষ্ট লাঘবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এগুলো তো রাতারাতি হয় না। একটু সময় লাগে। তিনি আরো বলেন, দেশের এতগুলো প্রতিষ্ঠানকে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য নীতিমালা সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় এই বছরেই থোক বাজেট দেবে নাকি আগামী বাজেটে দেবে তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে।

গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র ভোরের কাগজকে বলেছে, চারদিন আগে অনশনরত শিক্ষক কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির জন্য একটি নীতিমালা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এর জবাব গতকাল পর্যন্ত আসেনি। এর আগে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, এমপিওভুক্তির নীতিমালা প্রণয়নের জন্য অর্থ প্রতিমন্ত্রীকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। পরিস্থিতির অবনতিতে এখন শিক্ষক কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই নীতিমালা তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। যা অর্থ মন্ত্রণালয় এখনো চূড়ান্ত করেনি। জাবেদ আহমেদও স্বীকার করেছেন, এমপিওভুক্তির নীতিমালা চারদিন ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে।

এদিকে, নন-এমপিও শিক্ষক কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির জন্য কী পরিমাণ অর্থ লাগবে তার পরিসংখ্যান চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) চিঠি দিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো মাউশির ফিরতি চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে ৫ ধরনের ৭ হাজার ১৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে এমপিওবিহীন নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১ হাজার ২২৭টি, এমপিওবিহীন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১ হাজার ৮৯টি, এমপিওভুক্ত নি¤œ মাধ্যমিক থেকে উন্নীত হওয়া এমপিওবিহীন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৩ হাজার ২৭৫টি, এমপিওবিহীন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৫১৮ এবং এমপিওভুক্ত উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ থেকে উন্নীত হওয়া এমপিওবিহীন ডিগ্রি স্তরের কলেজ রয়েছে ১ হাজার ৩৩টি। এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করলে বছরে সরকারের ব্যয় হবে ২ হাজার ১৮৪ কোটি ২৭ লাখ ৫২ হাজার ২৫০ টাকা। সরকার একবারেই এত টাকা দেবে কি না তা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, শিক্ষকরা গত ৫ দিন ধরে অনশনে থাকলেও তাদের এমপিওভুক্তি দেয়ার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় দ্রুতগতিতে তৎপর নয়। কাজের ক্ষেত্রে এক ধরনের ঢিলেমি লক্ষ্য করা গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে অর্থমন্ত্রী টাকা দিলেই দ্রুত কাজ হবে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন। আর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গত বুধবার দুপুর থেকে সিলেটে রয়েছেন। শিক্ষকদের দাবি মেটাতে সক্ষম এই দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ঢাকার বাইরে থাকায় এমপিওভুক্তির নীতিমালা প্রণয়ন কিংবা এ খাতে নতুন করে কত টাকার বরাদ্দ দেয়া হবে- তার কোনোটিই এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এতে কাজে ঢিলেমি দেখা দেয়ার পাশাপাশি শিক্ষকদের কষ্ট আরো বেড়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) চৌধুরী মুফাদ আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা বরাদ্দ করাসহ নীতিমালাটি অনুমোদন করলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি প্রণীত এমপিওভুক্তির নীতিমালায় বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি করা যাবে। তিনি বলেন, ২০১০ সালের পর থেকে এত দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির কোনো চিন্তাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের ছিল না। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর সর্বশেষ আলোচনায় এমপিও দিতে রাজি হয়েছেন। তবে ব্যাপারটা এমন না যে সিদ্ধান্ত আছে আর দিয়ে দেয়া হলো। সরকারেরও তো প্ল্যান আছে, তাদের সামর্থ্য থাকতে হবে। তাই আমি বলব, শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবিগুলো তারা যেন বাস্তবতা বুঝে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করে।

২০১৩ সাল থেকে এমপিওভুক্তির (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) দাবি জানিয়ে আসছেন নন-এমপিও সরকারি শিক্ষকরা। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস দিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ফলে সর্বশেষ গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট এবং ১ জানুয়ারি থেকে আমরণ অনশনে নামেন শিক্ষকরা। গত ২ জানুয়ারি তাদের আবারো আশ্বাস দেয়ার জন্য উপস্থিত হন শিক্ষামন্ত্রী নিজে। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এরপরই এমপিও প্রত্যাশীদের বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে। কিন্তু গত চারদিনেও এটি আলোর মুখ দেখেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে নন-এমপিও শিক্ষক কর্মচারীদের জন্য কি রকম টাকা লাগবে তার একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এখন মন্ত্রণালয় পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ বলেছেন, মাউশির প্রস্তাবনা নিয়ে শিক্ষা এবং অর্থ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করবে। মন্ত্রণালয় ও মাউশি সূত্র বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নীতিমালার চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের ফলাফল, প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী, শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ কয়েকটি বিষয় মূল্যায়ন করে শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য নির্বাচন করা হবে। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ১৬ জুন সর্বশেষ নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি হয়েছিল।

শিক্ষকদের পাশে মহাজোটের শরিক নেতারা: শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সরকারের সমালোচনা করেছেন মহাজোটের শরিক দলের একাধিক নেতা। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে টানা ৫ দিন অনশনে থাকা নন-এমপিও শিক্ষকদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন তারা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়–য়া জাতীয় প্রেসক্লাবে আন্দোলনরত শিক্ষকদের মাঝে উপস্থিত হয়ে বলেন, শিক্ষকদের দাবি উপেক্ষা করে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংক, শিল্প ব্যাংকের অর্থ লুটপাট হয়েছে। ৪ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে ব্যাংক থেকে। এত টাকা চুরি হয় আর শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি বাবদ এক হাজার কোটি টাকা কেন ভর্তুকি দেবে না সরকার? দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা শিক্ষামন্ত্রীর সমালোচনা করে বলেন, শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য শিক্ষক বা সমাজের জন্য শোভনীয় নয়। এ ছাড়া জাতীয় প্রেসক্লাবের ভেতরে একটি অনুষ্ঠানে এসে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক বলে মন্তব্য করেন। শিক্ষকদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ২১ দফা কর্মসূচি ঘোষণাও করেন তিনি। উল্লেখ্য, শিক্ষকদের অনশন কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন থেকে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সংহতি প্রকাশ করতে শিক্ষকদের পাশে এসে দাঁড়ালেও প্রথমবারের মতো মহাজোটের শরিক দলের নেতারা শিক্ষকদের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করলেন।

 

সৌজন্যে: ভোরের কাগজ, ৫ জানুয়ারি। 

এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা - dainik shiksha শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030012130737305