আবরারের মৃত্যু ও বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি - দৈনিকশিক্ষা

আবরারের মৃত্যু ও বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আবরারের মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আবরার মরে গেছে—কিন্তু হাজার হাজার আবরার আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে বেঁচে আছে চারদিকে। এদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে—সুন্দর স্বাধীন জীবনের আকাঙ্ক্ষা হয়েছে ভূলুণ্ঠিত। এদের মা-বাবারা সন্তানদের কষ্টের কথা সাহস করে উচ্চারণ করতে শিহরিত হন। আবার মিডিয়ায় মায়েদের মায়াকান্না তাদের আরো বেশি বিপন্ন করে। এক বিচ্ছিন্ন ভূভাগে বসে বসে তাঁরা আঁচলে চোখের জল মোছেন আর অসহায়ের মতো আকাশ পানে তাকিয়ে নিজেদের নিবৃত করেন। শনিবার (১৯ অক্টোবর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, এই অসহায়ত্ব এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি একে একে প্রতিটি জনপদকে করে তুলেছে বিষণ্ন নগর। গ্রামেগঞ্জে আজ সন্ত্রাসের বিস্তৃতি। রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস দোর্দণ্ড প্রতাপে বিস্তৃত হচ্ছে। অতীতের সন্ত্রাসী আর নতুন সন্ত্রাসের গুরুরা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে সর্বত্র।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা আরো ভয়াবহ। দলবাজিতে শিক্ষকরা কে কত অনুগত—রীতিমতো তার প্রতিযোগিতা চলছে। মাথা যার যত বেশি নত, পদবিতে তিনি তত উন্নত। সরকারের সুদৃষ্টির আশায় এহেন নীচতা নেই, যার সঙ্গে এখন তাদের সম্পৃক্ততা নেই। ক্যাম্পাসে ভিন্ন মতাবলম্বীদের হাতুড়িপেটা করলে দায়িত্বশীল শিক্ষকরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমান বা অন্যদিকে নিবদ্ধ দৃষ্টিতে আপ্লুত থাকেন। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র-ছাত্রীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। হলগুলোতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে কেউ কেউ সেজে গেছে রাজাধিরাজ। গণরুম, গেস্টরুম, টর্চার সেল সবই এখন রূঢ় বাস্তবতা। এগুলোর প্রতি শিক্ষকদের কোনো দৃষ্টি নেই—প্রকৃত অর্থে দৃষ্টি দেওয়ার ক্ষমতাও নেই। টক শো বা মিডিয়াতে যতই বড় গলায় বকর বকর করেন না কেন, তাঁরা এখন অসহায়।

বুয়েটের ব্যাপারটা ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এখানে ইউকসু নির্বাচনের আগে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির বিতর্ক হতো। সেই দলহীন প্রচারণাই ছিল নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার মৌলিক অবলম্বন। নির্বাচনে জয়ীরাই হলে হলে ছাত্রবান্ধব কাজ করতেন—সুষ্ঠু সংস্কৃতির বিকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন মতের সবার সহাবস্থান নিশ্চিত করতেন। শিক্ষকরা পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি কাজের তদারকি করতেন। এখন আর সেই দিন নেই। ইউকসু নির্বাচন বছরের পর বছর আলোর মুখ দেখেনি। এই সুবাদে শিক্ষকরা হলগুলোর তদারকি একটি দলের অনুসারীদের হাতে তুলে দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এরা রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে সব অপকর্ম সংঘটিত করছে। এদের ওপর শিক্ষকদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। শিক্ষকরা এখানে অসহায়। কারণ এসব ছাত্র ও তাদের নেতাদের হাত বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। তাদের কিছু বলতে গেলে শিক্ষকদের আলোচনা করতে হয় তাদের গডফাদারদের সঙ্গে। এসব গডফাদারের জ্ঞান-বিজ্ঞানে ব্যাপ্তি এত বিশালতায় পূর্ণ যে তাঁরা বুয়েটের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ। আবার ক্যাডারদের সঙ্গে পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্কের কারণে তাদের অন্যায় আবদার উপেক্ষাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। আর যেহেতু শিক্ষকরা সিঁড়ি আরোহণে ওই সব গডফাদারের মুখাপেক্ষী, তাই তাঁরা শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারেন না চারপাশে সংঘটিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ফল যা হওয়ার, হয়েছে তাই। লাগামহীন ক্যাডাররা দানবে পরিণত হয়েছে। এরা অত্যাচার, অবিচার, নিপীড়ন, নির্যাতন, হয়রানি, লুণ্ঠন, হত্যা সবই করছে নির্বিবাদে।

আবরার আক্রান্ত হওয়ার পর বুয়েটের কর্তাব্যক্তিরা জানেননি এ কথা গ্রহণযোগ্য নয়। হলে পুলিশ পর্যন্ত এসেছে অথচ তাঁরা আসেননি। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মতো তাঁরাও ছিলেন নির্বিকার। উপাচার্যরা দলীয় আনুগত্যের কারণে এঁদের পেট্রনরূপেই আবির্ভূত। তাঁদের কাছে নির্যাতিতরা গিয়ে সুবিচার পাবে—এটা দুরূহ। আবরারের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় জনৈক উপাচার্য বলেছেন, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্রের গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। এ কথা বলার পরই তাঁর নাকের ডগায় একটি ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা অন্য ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করেছে। তিনি এবার নীরব। কারণ মিডিয়ায় চাপাবাজির বেশি কিছু করার ক্ষমতা দলবাজ উপাচার্যদের নেই। উপাচার্যদের দুর্নীতি ও অনিয়মের যে খতিয়ান আস্তে আস্তে সামনে আসছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে নিজেদের নির্ধারিত সময় পার করতে পারলেই তাঁদের স্বর্গসুখ। অহেতুক হাতুড়ি, লাঠি, নির্যাতন বিষয়ে সম্পৃক্ত হয়ে সম্পর্ক বিনষ্ট না করে যেমন চলছে তেমনি চালিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার লক্ষ্যই এখন তাঁদের সর্বৈব ব্রত। সন্তানতুল্য ছাত্রের এ অমানবিক নির্যাতনে মৃত্যুর পর তাঁর মুখ দেখার সৎসাহসটুকু ছিল না তাঁর। এতই রাজনীতি অনুগত হয়েছেন যে বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত সমাহিত ছাত্রের কবরে গিয়েছেন পুলিশ ও ক্যাডার পরিবেষ্টিত অবস্থায়। এর কোনোটিই শিক্ষকসুলভ হয়নি। অভিভাবকত্বের যোগ্যতা তিনি হারিয়েছেন অনেক আগেই।

শিক্ষকদের অবস্থাও যে খুব একটা উজ্জ্বল তা বলার অবকাশ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদের হস্তক্ষেপ অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করেছে। শিক্ষকদের সব কিছুতে উপাচার্যের দিকে তাকাতে হয়। আর উপাচার্যরা তাকান তাঁদের নিয়োগকর্তাদের দিকে অবনতচিত্তে। ফলে সব আশা-আকাঙ্ক্ষা ভূলুণ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্মুক্ত চত্বরে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় ছাত্ররাজনীতি বন্ধের মধ্যে নয়—রাজনীতি আছে, থাকবে। কিন্তু রাজনৈতিক সংগঠনের লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি পরিহার করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব নির্ধারণে কোনো গণতান্ত্রিক চর্চা নেই, পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্কের ভিত্তিতে বিভিন্ন লেনদেনে এগুলো নির্ধারিত হয়। ফলে জাতীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে একেবারে নিচ পর্যন্ত এক দুষ্টচক্রের বিস্তার ঘটেছে। এখানে যেমন থাকে ক্ষমতার বিন্যাস, তেমনি থাকে আর্থিক ভাগ-বাটোয়ারার ব্যাপার। এ অবস্থার পরিবর্তন না ঘটাতে পারলে সব উদ্যোগই ভেস্তে যাবে। অর্থাৎ পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্কে ছেদ ধরাতে হবে—ডিলিংক করতে হবে এই সম্পর্ককে। অন্যথায় এত চিৎকার অর্থহীন হয়েই থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে একটু সাহসী হয়ে নিয়মিত নির্দলীয় ভিত্তিতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন দিয়ে ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে হবে। বিশ্বের খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আলোর পথে ধাবিত হবে যদিবা এগুলো স্বাধীন গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্ররূপে আবির্ভূত হয়। অবশ্য এ জন্য ভিসি নিয়োগে দলীয় আনুগত্য নয়—মেধা ও মননকে যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। অন্যথায় বুয়েটের মতো মধ্যযুগীয় বর্বরতার করাল গ্রাসে নিপতিত হবে সব। তবে প্রথমেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং নিষিদ্ধ করতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে লালন করা এবং তাদের অধিকার অর্জনে সহায়তার ওপরই নির্ভর করবে আগামীর সাফল্য।

নাসির উদ্দিন আহমদ নোমান : সাবেক শিক্ষক বুয়েট ও ডিন, কলা ও আধুনিক ভাষা অনুষদ, লিডিং ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।

শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038201808929443