আমি নুসরাতের মা বলছি! - দৈনিকশিক্ষা

আমি নুসরাতের মা বলছি!

রাশেদা রওনক খান |

আজ পহেলা বৈশাখে নতুন আলোয় সেজে উঠবে বাংলাদেশ! প্রস্তুতি শেষ, এবার উদযাপনের পালা। এবার বাড়তি পাওনা, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবেন। আপনারাও উদযাপনের জন্য তৈরি বর্ণিল সাজসজ্জায়; পত্রিকার পাতাগুলো সাজবে নতুন সাজে; নতুন বছরকে স্বাগত জানাবে প্রতি ঘণ্টায় নিউজ রিডাররা তাদের চ্যানেলগুলোতে; প্রতিটি চ্যানেল প্রতিযোগিতায় নামবে কে কত সেলিব্রিটি এনে সুন্দর প্রোগ্রাম বানাতে পারে; বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো তৈরি নতুন বছরে নতুন বিজ্ঞাপন বাজারে ছাড়তে; দোকানগুলো আগের রাতে ধুয়েমুছে পরিস্কার করা হচ্ছে।

হালখাতা খুলতে প্রস্তুত ব্যবসায়ীরা, নতুন বউ বায়না ধরেছে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি কিনে দেওয়ার জন্য; হাতে-পায়ে আলতা আর মেহেদি দিয়ে তৈরি কিশোরীর দল; মেলায় নাগরদোলায় চড়ে বেড়াবে শিশুদের দল; চারদিকে চলবে অজস্র মানুষের কোলাহল; আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবরের মতো বলবে- নিরাপত্তাবেষ্টিত থাকবে মঙ্গল শোভাযাত্রা, সেই বর্ণিল যাত্রায় শামিল হবে তোমরা সবাই নানা রঙের পোশাক, মুখোশ আর ফানুস নিয়ে! বস্তিতে প্রতিদিনের পান্তা-ভর্তাই বৈশাখের মেন্যু। ধনীর বাড়িতে আলাদা করে গরম ভাতে পানি ঢেলে বড় দামি ইলিশের মেন্যু আর মধ্যবিত্তের দুটির সমন্বয় ঘটিয়ে বৈশাখ উদযাপনের চেষ্টা...ঘরে ঘরে ইলিশ; না হয় অন্য কোনো মাছ রান্না করবে মায়েরা... মা রান্না করে বসে থাকে কখন ছেলেমেয়ে সেজেগুজে মেলা থেকে ফিরে তার হাতে রান্না খাবে!

আপনারা, আপনাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যখন এই বর্ণিল বৈশাখ উদযাপনে মত্ত, তখন কী করছে আমার মতো নুসরাত, তনু, রূপা, তানহা, আফসানার দুঃখিনী মায়েরা? আমাদেরও তো বড় সাধ জাগে কলিজার ধন মেয়েকে বুকে টেনে ধরতে। আমরা কী করব এই দিনে? দেশবাসী, আমাদের জীবনের বৈশাখী আনন্দ কেড়ে নিল যারা, তাদের সঙ্গেই তো আজ আপনারা বৈশাখের আনন্দে মত্ত হয়েছেন। তারাও আছে আপনাদের মঙ্গল শোভাযাত্রায়। তারাও আপনাদের সঙ্গে ফানুস ওড়াচ্ছে।

নয়তো বৈশাখীর আনন্দ মিছিলে নারীর শ্নীলতাহানির চেষ্টা চলে কীভাবে? কীভাবে আমাদের মেয়েদের মতো সেদিন অনেকেই নিপীড়িত হয়? কেন এই আনন্দ আয়োজনে প্রতিবার র‌্যাব-পুলিশকে বলতে হয়- নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করা হয়েছে? কেন আমাদের মাঝেই আমরা নিরাপদ নই? কেন আমার কিংবা আমাদের মেয়েরা হারিয়ে গেল এই নষ্টদের হাতে কষ্ট পেয়ে? এত কিছুর পরেও আপনারা আবার যাচ্ছেন আনন্দ মিছিলে; আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও শিকড়ের সন্ধানে! বাঙালির প্রাণের উৎসব এই বাংলায়, এর চেয়ে বড় উৎসব আর কী হতে পারে যেখানে শ্রেণি, বয়স, লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এক হয়ে যায়? কিন্তু আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন- সবাই কি এক হয়? এই সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও কিড় আমাদের এক ভাবাতে শেখায়? একই যদি হতো, একই যদি ভাবত, তবে আজ কেন আমি সন্তানহারা এক দুঃখিনী মা? এত আনন্দের মাঝে কেন আজ আমার বা আমাদের ঘরে বৈশাখের আনন্দ নেই? কেন আমার বা আমাদের মেয়েরা হারিয়ে গেল এভাবে? কেন তাদের হত্যাকাণ্ড কিংবা ধর্ষণের বিচার হয় না? কেন এত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বিচার প্রক্রিয়ার এত দীর্ঘসূত্রতা দেখতে হয়? কেন এখানে টাকার খেলা চলে? কীভাবে এখানে ধর্ষক, খুনি, নিপীড়ক হয়ে ওঠে ক্ষমতাশালী আর আমরা হয়ে যাই নিরীহ প্রাণী, যার ওপর প্রতি মুহূর্তে চলে মেরে ফেলার হুমকি-ধমকি? কীভাবে এই হায়েনারা এখনও আমাদের প্রতি মুহূর্তে হেনস্তা করে? রাষ্ট্র কি সেই খবর রাখে? কীভাবে আমি বা আমরা প্রতিদিন বুকে তীব্র ব্যথা নিয়ে দিন কাটাই, সে না হয় না-ই জানলেন আপনারা।

কিন্তু কন্যা হত্যার বিচারটুকুও আপনারা আমাদের দেখতে দেবেন না? আহারে মা আমার! কত কষ্ট পেয়েছে, মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করেছে... যেই জানোয়ারদের অত্যাচার সহ্য করে চলে গেছে, সেই জানোয়ারগুলোর ক্ষমতার দাপট দিন দিন বাড়তেই থাকে!

বিচার পাই না আমরা। আদালতের প্রতিটি সিঁড়ি আমাদের চোখের জলে ভিজেছে অথচ আপনাদের ভাবায় না, কষ্টও দেয় না? কখনও কি নিজেকে আমার বা আমাদের জায়গায় রেখে ভেবেছেন আপনারা? আপনারা কি দেখতে পান আমাদের চোখের কান্নায় আর পানি নেই? শুকিয়ে গেছে আমাদের এই চোখ দুটি? এই আপনারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, সমাজ পরিচালনা করছেন, ডাক্তারি বিদ্যা নিয়ে রোগীদের বাঁচিয়ে তুলছেন, বুয়েটে পড়ালেখা করে বড় বড় ইমারত তৈরি করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে শিক্ষক হচ্ছেন কিংবা আমলা হচ্ছেন, রাজনীতি করছেন, নাটক-সিনেমা বানাচ্ছেন, বড় বড় ব্যবসায়ী হচ্ছেন, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন, জাপান কিংবা আমেরিকার কোনো ল্যাবে বসে রসায়ন, পদার্থ কিংবা অঙ্কশাস্ত্রের কঠিন সূত্র মেলাচ্ছেন, প্রবাসীরা নিজেদের জীবন সুখ-শান্তিতে কাটিয়ে দিচ্ছেন।

কিন্তু এত কিছুর ভিড়ে এই দুঃখিনী মায়েদের দুঃখ কি একটুকুও আপনাদের ছোঁয় না? আপনারা কি কখনও কোনোদিন জানতে চেয়েছেন- বেঁচে থেকেও মৃত আমি, আমরা কীভাবে দিন কাটাই? এই রাষ্ট্র কি কোনোদিন খবর নেয় আমাদের প্রতিটা দিন কীভাবে কত নতুন নতুন নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যায়? এত সংগঠন- কে কবে আমার, আমাদের কাছে এসেছে দুঃখের কথা শুনতে? এত চ্যানেল, পত্রপত্রিকা কেউ কি আমার বা আমাদের কোনো খোঁজ নেয়- আমরা সন্তানহারা মায়েরা কেমন আছি, কীভাবে কাটাই এই দিনগুলো? আমাদের কলিজার ধনকে মাটির নিচে রেখে- কেউ কি এসবের খোঁজ নিতে আসে? না-ইবা আসুক, দরকার নেই আপনাদের সান্ত্বনা, যা দরকার আমাদের কন্যা হত্যার বিচার! সেটাও আপনারা আমাদের দেবেন না? তাহলে কী লাভ এত পড়ালেখার? কী লাভ এই রসায়ন কিংবা পদার্থবিজ্ঞানের ল্যাবে বসে গবেষণার? কী লাভ এই জজ-ব্যারিস্টার হয়ে? কী লাভ এত বড় রাজনীতিবিদ হয়ে, যদি নিজ দেশের দুঃখিনী মায়েদের একটা বিচার করে দিতে না পারেন? অন্তত বিচার চেয়ে পাশে দাঁড়াতে না পারেন? 

আমি জানি, আপনারা আপনাদের নিজের জীবন, সন্তানের জীবন কিংবা বৈশাখের এই সামাজিক জীবনের আনন্দ মিছিলকেই প্রাণবন্ত করার চেষ্টায় মত্ত, আমার দীর্ঘশ্বাস আপনাদের ভাবায় না, কাঁদায় না...আমি জানি, স্বার্থপরের দুনিয়ায়, এই আমি একলাই কাঁদব, এই সমাজ অতি স্বার্থপর...দু'দিন চিৎকার করে পরদিন ভুলে যাই আমাদের নুসরাত, তনু, আফসানা, পূজা, রিসা, তানহা, রূপাদের। আহারে! আপনাদের মতো যদি স্বার্থপর হতে পারতাম, ভুলে যেতে পারতাম! নাড়িছেঁড়া ধন আমার, পাশে নেই; শুয়ে আছে মাটির নিচে কত কষ্ট, লাঞ্ছনা, অত্যাচার, নিপীড়নকে সঙ্গে নিয়ে- সেই বেদনা আপনাদের ছুঁয়ে না যাক, অন্তত আমাদেরকে আমাদের কন্যা হত্যার বিচার পেতে সাহায্য করুন আপনারা! এইটুকু চাওয়া রইল আজকের দিনে আপনার কাছে, আপনাদের কাছে।

 

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: সমকাল

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040180683135986