আহমদ ছফার আত্ম অন্বেষণ - দৈনিকশিক্ষা

আহমদ ছফার আত্ম অন্বেষণ

দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক |

শ্রম, ঘাম, প্রেম ও দ্রোহ মেশানো শব্দ ছেনে তুলে বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন অমৃতের সন্তান আহমদ ছফা। তবে সেসব সাহিত্যকর্ম কলাকৈবল্যবাদে আক্রান্ত নয়, বরং প্রবলভাবে সময় ও আবেগতাড়িত। কালের প্রয়োজনে, প্রতিকূলতা ঠেলে তিনি চিত্রশিল্পী সুলতানের পেশিবহুল কৃষকের লাঙল চালানোর মতোই চালিয়ে গেছেন কলম। আহমদ ছফার সবচেয়ে, সম্ভবত আলোচিত ও আলোড়ন তোলা প্রবন্ধের নাম 'বাঙালি মুসলমানের মন'। এই লেখাটিও তীব্র অনুভূতির আলোড়ন মাথায় নিয়ে এক লহমায় রচিত হওয়া এক কালজয়ী রচনা। বুধবার (২৮ জুলাই) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায় প্রবন্ধটিতে 'শহীদে কারবালা'র মতো পুথি সাহিত্যকে অবলম্বন করে আহমদ ছফা এই ভূখণ্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অন্দরমহলের খোঁজ নেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। আলোচ্য পুথিতে যেমন দেখা যায়, কারবালা থেকে দামেস্ক যাওয়ার পথে হযরত হোসাইনের ছিন্নমস্তকের অলৌকিক কাণ্ড, অর্থাৎ মরুভূমির ভেতর ছিন্নমস্তক এক ব্রাহ্মণ পরিবারকে কলেমা পড়িয়ে মুসলমান ধর্মের অনুসারী করে ফেলে। ঠিক তেমনি 'চৈতন্যচরিতামৃত'র ভেতরেও আমরা দেখি, চৈতন্যদেব সংকীর্তন করতে করতে পুরী থেকে বৃন্দাবন যাচ্ছেন; যাত্রাপথে বনের মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটে বাঘের সঙ্গে। বাঘকে চৈতন্য শুধু বললেন, বলো কৃষ্ণ কৃষ্ণ, আর তখনই বাঘের মুখে বুলি ফোটে। সে 'কৃষ্ণ কৃষ্ণ' বলে হরিণদের সঙ্গে নাচতে শুরু করে দেয়। আমরা জানি, প্রথম অলৌকিক ঘটনাটির উল্লেখ রয়েছে 'বাঙালি মুসলমানের মন' প্রবন্ধে। আর দ্বিতীয়টির বর্ণনা পাওয়া যায় নীরদচন্দ্র চৌধুরীর 'আত্মঘাতী বাঙালী' গ্রন্থে। দুই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, এ অঞ্চলের মানুষ ধর্মপ্রাণ। তারা যুক্তি-বুদ্ধিরহিত ধর্মবিশ্বাসের জয় দেখতে চায় সর্বক্ষেত্রে।

আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’

বনের মাঝে বাঘের দেখা পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ভারত উপমহাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরে মরুভূমির ভেতর ব্রাহ্মণ পরিবার আসাটা যুক্তিসম্মত নয়। তবে কেন তাদের উপস্থিতি পাওয়া যায়, এমনকি হাল আমলের 'বিষাদ সিন্ধু'তেও সেই সুলুক সন্ধানে রত ছফা।

আহমদ ছফা প্রবন্ধের শুরুতে দেখান, সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে যে মনোভঙ্গি গড়ে উঠেছিল, পুথি লেখকদের মাঝে সেটাই ফুটে উঠেছে তাদের লেখায়। যেমন হিন্দু বর্ণপ্রথার প্রতি তাদের যে ক্ষোভ, সেটাই বেরিয়ে এসেছে ব্রাহ্মণের ধর্মান্তরের ভেতর দিয়ে। একই রকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটেছে মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব সাহিত্যের হিন্দু রচয়িতাদের ভেতরেও। তবে ছফা মনোনিবেশ করেছেন পুথি সাহিত্যের আলোকে বাঙালি মুসলমানের মনের অবস্থা বিচার করতে। তিনিও নীরদচন্দ্রের মতোই বলতে চেয়েছেন, বাঙালি মুসলমানও আসলে আত্মঘাতী। এর কারণ হিসেবে ছফা প্রবন্ধের শেষভাগে বলছেন, 'বাঙালি মুসলমান সমাজ কোনো কিছুই মনের গভীরে গ্রহণ করে না, জানার ভান করে মাত্র। অপরিপকস্ফতার বিষয়টি ভুলে থাকার জন্য সে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে কসুর করে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাঙালি মুসলমান সবচেয়ে ভয় করে স্বাধীন চিন্তাকেই।'

কথা হলো, এই ভয় কি শুধু বাঙালি মুসলমানের? গোটা বিশ্বেই দেখি স্বাধীন চিন্তাকে ভয়ের সংস্কৃতি এবং আরও দেখি, শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকে আরও বেশি করে ভয়ের সংস্কৃতি সাধারণ মানুষের মাথার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই সংস্কৃতির বিস্তার এখন যেন এক নয়া মহামারি। যদিও জর্জ ওরয়েল অনেক আগেই কল্পবিজ্ঞান '১৯৮৪' উপন্যাসে এই সংস্কৃতির কথা বিধৃত করেছেন, কিন্তু সেটা বর্তমান বিশ্বে আর কল্পনা নয়, বাস্তবে রূপ নিয়েছে। যে সংস্কৃতি এখন সর্বজনীনপ্রায়, তাহলে আহমদ ছফা কেন শুধু বাঙালি মুসলমানের কথা উল্লেখ করেছেন? কারণ, তিনি এ বর্গের ভেতরকার মানুষ বলেই। একে বলা যেতে পারে আত্মসমালোচনা, আত্ম অন্বেষণ। সেটা করার সাহস সবার থাকে না।

ছফা বলছেন, 'বাঙালি মুসলমানদের মন যে এখনও আদিম অবস্থায়, তা বাঙালি হওয়ার জন্যও নয় এবং মুসলমান হওয়ার জন্যও নয়। সুদীর্ঘ কালব্যাপী একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুন তার মনের ওপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত রয়েছে, সজ্ঞানে তার বাইরে সে আসতে পারে না।' অর্থাৎ ছফা স্পষ্টই এখানে ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করছেন। প্রাচীনকাল থেকে চর্চিত সমাজনীতি ও রাজনীতির দরুন যে ঘেরাটোপের ভেতর বাঙালি মুসলমান বর্গ আবদ্ধ; সে পরিস্থিতিকে নির্মোহভাবে জানার চেষ্টা করলে আহমদ ছফা আশাবাদী- এ অবস্থার নিরসন ঘটবে। প্রকৃত মুক্তির পথ নিরূপিত হয় নিরপেক্ষভাবে জানা ও বোঝার পরই।

আহমদ ছফার এ লেখায় মূলত সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির কথাই বলা হয়েছে, বিশেষ করে দরিদ্র বাঙালি মুসলমানদের কথা। গোঁড়ামি আর অন্ধবিশ্বাসের চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে না পারার কথা। অথবা বিশেষ পরিস্থিতিতে নিজের বিশ্বাসে অটল থাকতে না পারার কথা। কিংবা যুগ যুগ ধরে বিদ্বেষ পুষে রাখার ফলে সমাজ ও রাজনীতির গতিমুখ পাল্টে ফেলার কথা। আহমদ ছফা মস্তিস্কের পাশাপাশি হূৎপিণ্ড দিয়ে আপন বর্গের দ্বিচারিতা ও পরাঙ্‌মুখতাকে জানা ও বোঝার চেষ্টা করেছেন। তাই সেখানে সাম্প্রদায়িকতা নেই; আছে একটি সম্প্রদায়কে বোঝার আকুতি।

লেখক : বিধান রিবেরু, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন

ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির - dainik shiksha অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038449764251709