ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের নিবন্ধন ও মূসক - দৈনিকশিক্ষা

ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের নিবন্ধন ও মূসক

সমীর রঞ্জন নাথ |

প্রায় সব ধরনের পণ্য ক্রয়ের ওপর সমহারে মূল্য সংযোজন কর বা মূসক প্রবর্তনের জন্য আমাদের অর্থমন্ত্রী প্রায় মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে জাতীয় সংসদে আসন্ন অর্থবছরের (২০১৭-১৮) জাতীয় বাজেট পেশ করার মাসখানেক আগে থেকে তাকে এ বিষয়ে যথেষ্ট সোচ্চার হতে দেখা গেছে। প্রচারণাই যেন এক প্রকার। সুযোগ পেলেই বলছিলেন ১৫ শতাংশ হারে মূসক আদায়ের কথা এবং তা অর্থবছরের প্রথম দিন থেকেই। অর্থমন্ত্রী তার আকাঙ্ক্ষার অর্ধেকের বেশি পরিমাণ জয়ী হয়েছেন। তিনি তার নির্ধারিত হার ও মূসক চালুর লগ্ন ঠিক রাখতে পেরেছেন। কিন্তু তাকে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পণ্যের তালিকা খাটো করতে হয়েছে। তালিকা খাটো হলেও ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ের শিক্ষা তার তালিকায় রয়েই গেছে।

ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর মূসক প্রবর্তন নতুন কোনো ইস্যু নয়। আমাদের দেশে পণ্য ক্রয়ের ওপর মূসক আদায় শুরু হয় ১৯৯১-৯২ অর্থবছর থেকে। তারপরও ২০০৬-০৭ অর্থবছর পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের শিক্ষা পণ্য তালিকার বাইরেই ছিল। এটি যুক্ত হয় সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম বাজেট থেকে। সরকার ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর চার দশমিক পাঁচ শতাংশ হারে মূসক প্রবর্তন করে। অর্থবছর ২০১৫-১৬-তে তা বাড়িয়ে সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ করা হয়। আসন্ন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে সমহারের বিবেচনা থেকে তা ১৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয়, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পণ্য তালিকা খাটো করা হলেও তা থেকে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা বাদ পড়েনি।

উল্লেখ্য, সরকার ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকেও পণ্য বিবেচনায় ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ের মতোই চার দশমিক পাঁচ শতাংশ হারে মূসক জালের আওতাভুক্ত করার চেষ্টা করেছিল। পরে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে একইভাবে এই হার সাত দশমিক পাঁচ শতাংশে উন্নীত করা হয়। এ কথা স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং তার অধীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিবেচনায় ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পণ্যস্বরূপ।

বিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এক নয়। প্রথমোক্ত দল বয়সে নবীন, তাদের থাকতে হয় অভিভাবকদের শাসনতলে; সমাজবাস্তবতায় কীভাবে কী করতে হয়, তার ভেদবুদ্ধিও হয়তো তাদের অতটা প্রখর নয়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ আলাদা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ওপর মূসক আদায়ের সরকারি প্রচেষ্টা দু’বারই ভণ্ডুল হয়ে যায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে। অর্থমন্ত্রীর এবারের তালিকায়ও এটি নেই। এর থেকে এ কথা বলার অবকাশ তৈরি হয় যে, দেশের শক্তিশালী বণিক সম্প্রদায়ের চাপে মূসক আদায়যোগ্য পণ্যতালিকা খাটো হয়, তরুণ ও যুব সম্প্রদায়ের শক্তির আন্দোলনে তাদের শিক্ষা তালিকাভুক্ত হয় না; অন্যদিকে শিশুরা তুলনামূলক শক্তিহীন বিধায় তারা করজালে আটকা পড়ছে।

ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কয়েকজন অভিভাবকের আর্জির পরিপ্রেক্ষিতে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে আদালত টিউশন ফির ওপর মূসক আদায় বন্ধ রাখতে আদেশ প্রদান করেন। এর ফলে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শেষ চার মাস শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর কোনো মূসক নেওয়া হয়নি। আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অর্থমন্ত্রী কীভাবে মূসক তালিকায় এটি রাখতে পারলেন, তা বোধগম্য নয়। তাহলে কি আদালতের নির্দেশনা জাতীয় সংসদে প্রস্তাবনার ওপর কোনো প্রভাব রাখতে পারে না?

এখন প্রশ্ন হলো, দেশীয় শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে বাংলা বা ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান করা হয় যেসব বিদ্যালয়ে, সেখানকার শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর কোনো মূসক ধার্য করা হয় না আর বিদেশি শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান করা হয় এমন বিদ্যালয়ের জন্য ভিন্নতর নিয়ম কেন? এমনিতেই ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের কার্যক্রম তদারকিতে সরকারের কোনো ব্যবস্থা নেই, একেক বিদ্যালয় একেক পরিমাণে টিউশন ফি ধার্য করে এবং তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত। ফলে দুই ধরনের বিদ্যালয়ের মধ্যে এক প্রকার বৈষম্য রয়েই গেছে। তার ওপর মূসক আদায় করে এই বৈষম্য আরও বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। প্রচলিত আছে যে, বিত্তবান ঘরের ছেলেমেয়েরাই ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। বিষয়টি তা নয়। মধ্যবিত্ত ঘরের অনেকেও এ ধরনের বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এক হিসাবে দেখা যায়, যে ১৫০টি নিবন্ধিত ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় মূসকের আওতায় রয়েছে, সেগুলোতে প্রায় এক লাখ ৯৩ হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। সরকার কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের প্রতি তার দায়দায়িত্বের কথা মাঝে মধ্যেই বলে থাকেন অথচ ইংরেজি মাধ্যমের এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর শিক্ষা তার চোখের আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে। কেবল মূসক নেওয়ার ক্ষেত্রে এরা সরকারের চোখে ধরা পড়ে!

ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের নিবন্ধনের বিষয়টি আলোচনায় আনা দরকার। শিক্ষাবিষয়ক কার্যক্রম তদারকি ও সমন্বয় করার জন্য আমাদের দুটি মন্ত্রণালয় রয়েছে_ একটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং আরেকটি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার জন্য। অথচ এদের কোনোটিতেই ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের কাজকর্ম দেখভালের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সেল বা কর্মকর্তা নেই। তাহলে এই বিদ্যালয়গুলোর নিবন্ধন কোথায় হলো? উত্তর শুনে অনেকেই চমকে যেতে পারেন। এই বিদ্যালয়গুলো জয়েন্ট স্টক কোম্পানি আইনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধিত! শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কোনো সেল না খুলে কেন এগুলোকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যুক্ত করা হলো, তার জবাব নিশ্চয় সরকার দেবে। শিক্ষার মতো সামাজিক খাতকে কেন বাণিজ্য খাতভুক্ত করা হলো, তা বোধগম্য নয়। ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সমমানের ও-এ লেভেল পরীক্ষা পাস করে অনেক শিক্ষার্থীই এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হয়।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে দুটি প্রস্তাব সরকারের বিবেচনার জন্য পেশ করতে চাই। প্রথমত, শিক্ষা পণ্য নয় এ কথা মনে রেখে ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের নিবন্ধন ও তদারকির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি আলাদা সেল খোলা দরকার। যেমনটি রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধন ও কার্যক্রম দেখাশোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে আলাদা সেল। প্রয়োজনে এগুলোর সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের মতো স্বতন্ত্র একটি আইনও প্রণয়ন করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, দেশে প্রচলিত অন্যসব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মতো ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাকেও মূসকের আওতামুক্ত করা। কেবল মাধ্যম ও শিক্ষাক্রম ভিন্ন বলেই মূসক দিতে হবে এটি কোনো যুক্তির কথা নয়। বিশেষ করে বর্তমান সরকার যখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বহু বিদ্যালয় ও কলেজ জাতীয়করণ করছে এবং অনেকের জন্য বিনা বেতনে পড়ালেখার ব্যবস্থা করেছে। নিজ উদ্যোগে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা সরকারের উচিত নয়। বরং যারা এটিকে পণ্য বানাতে চায় তারা যেন তা করতে না পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাই সরকারের কাজ।

কর্মসূচি প্রধান, শিক্ষা গবেষণা ইউনিট গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগ, ব্র্যাক

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042140483856201