উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে একজন শিক্ষকের বিনীত নিবেদন | মতামত নিউজ

উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে একজন শিক্ষকের বিনীত নিবেদন

আজ প্রায় দেড় বছর হতে চলল করোনা মহামারীর।করোনাতে থমকে গেছে সমগ্র বিশ্ব। আর আমাদের মতো দুঃখ দারিদ্র্যের দেশের অবস্থা তো দিনকে দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার আশার আলো জ্বললেও তা যেন করোনার ভয়াল থাবায় অনেক গুণ পিছিয়ে গেছে। করোনা বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানকে তিনগুণ পেছনে ঠেলে দিয়েছে । এমতাবস

আজ প্রায় দেড় বছর হতে চলল করোনা মহামারীর। করোনাতে থমকে গেছে বিশ্বের অধিকাংশ। আর আমাদের মতো দুঃখ দারিদ্র্যের দেশের অবস্থা তো দিনকে দিন অবনতির দিকেই। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার আশার আলো জ্বললেও তা যেন করোনার ভয়াল থাবায় অনেক ধাপ পিছিয়ে গেছে। করোনা বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানকে তিনগুণ পেছনে ঠেলে দিয়েছে । এমতাবস্থায় আমরা সকলেই অসহায়। এ অবস্থার উত্তরণ কবে হবে তা আমরা জানি না।

করোনার বিরামহীন আক্রমণে দেশের অর্থনীতির ভিত নড়ে গেছে। আর এর প্রভাব পড়েছে দেশের নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের ওপর। নিম্নবিত্ত শ্রম-পেশার মানুষের আয়-রোজগারে পড়েছে ভাটা।পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা এক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। উপার্জনের নতুন কোন পথ তারা আবিষ্কার করতে পারছে্ন না। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যুগে যুগে যেসব মহামারী পৃথিবীতে এসেছে তাতে- “ ধনী আরও ধনী হয়েছে, গরীব হয়েছে আরও গরীব”। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ চিত্র ব্যতিক্রম নয়। সরকার ত্রাণ, সাহায্য- সহযোগিতা যতটুকু দিচ্ছেন তা প্রাপ্য ব্যক্তির হাতে পৌঁছানোর আগেই মধ্যস্বত্বভোগীদের দখলে চলে যাচ্ছে। আর এ ধরনের চিত্র আমাদের চোখে স্বল্প পরিসরে ধরা পড়লেও অধিকাংশই আমাদের দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যায়। সমাজের মানুষের মধ্যে মূল্যবোধের চর্চার অবনতির কারণেই বোধ হয় এ রকম অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষই নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত; এ সংকটময় সময়ে আমরা যদি তাদের ব্যথা-বেদনা না বুঝে অমানবিক আচরণ করি তাহলে একসময় তা বড় রকমের বিদ্রোহে পরিণত করতে পারে। তাই যে যেখানে যে অবস্থানে আছি, আমরা যেন মানবিক হই। নিম্নবিত্ত শ্রেণি পেশার মানুষ যেভাবেই হোক; যে ক’জনই হোক তারা তাদের মনের কথাগুলো, কষ্টগুলো বলতে পারছে। কিন্তু সমাজে এমন অনেকেই আছেন যারা তাদের কষ্ট, অসহায়ত্ব, অন্য কারো কাছে বলতে সংকোচ বোধ করেন। কখনো আধপেটে, কখনোবা না খেয়ে তারা নীরবে নিভৃতেই চোখের জল ফেলেন।

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর সেই মেরুদণ্ডকে সঠিক ও শক্তভাবে নির্মাণের জন্য যুগ যুগ ধরে শিক্ষক নিরলস পরিশ্রম  করে আসছেন। বিভিন্ন দেশে শিক্ষকতা পেশায় যে সুযোগ সুবিধা রয়েছে তা পর্যালোচনা করলে এদেশে শিক্ষক হতে পারাটাই কোনও কোনও ক্ষেত্রে নিজের আফসোসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। করোনাকালীন শিক্ষকেরা বিশেষ করে যারা সরকারি সুবিধার বাইরে, তারা কেমন আছেন আমরা কি জানি? যে শিক্ষক প্রতিবছর তৈরি করেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এমপি, সচিবসহ আরও অনেক শ্রেণি -পেশার মানুষ তারাই দিনাতিপাত করছেন নিদারুণ সংকটে। বিশেষ করে যারা নন-এমপিও শিক্ষক তাদের বুক ফাটা কান্না কেউ শুনতে পায় না।

দেশে নন- এমপিও শিক্ষক কর্মচারী প্রায় ১ লক্ষ ৬৭ হাজার। তাছাড়া দেশে প্রায় ৪০ হাজার কিন্ডার গার্টেন স্কুল রয়েছে, সেখানে প্রায় ৬ লক্ষাধিক শিক্ষক কর্মচারীর বেতন বন্ধ। আমরা এমন সংবাদও শুনতে পাই শিক্ষককে জীবিকার প্রয়োজনে সবজি/মাস্ক বিক্রি করতে হচ্ছে। শহর ছেড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে পাড়ি জমাতে হচ্ছে। কেউ গ্রামে গিয়ে পরিবারের জন্য উপার্জনের নিমিত্তে ছোটখাটো ব্যবসা করার চেষ্টা চালাচ্ছেন; তাতেও জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে না। যে শিক্ষক জাতির বিবেক তাদের এই করুণ অবস্থা আমাদের নীতি নির্ধারক পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে কি?

করোনার আগে দেশে বেকার সংখ্যা ছিল প্রায় ২৭ লক্ষ। এপ্রিল-জুলাই সময়ে বেকারত্ব প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। আইএলও  বলছে, করোনা মহামারীর কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে তরুণ প্রজন্ম। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশই বেকার হয়েছেন।  করোনার কারণে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বে হার দ্বিগুণ হয়েছে।

আইএফসি-র এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, কোভিড-১৯ এর কারণে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। করোনার কারণে পোশাক খাতের ১ লাখের বেশি কর্মী কাজ হারিয়েছেন। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ১ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও বর্তমান পরিস্থিতির চিত্র ভিন্ন। করোনার আগে থেকেই চাকুরির বাজার মন্দা ছিল। এরূপ পরিস্থিতিতে বেকাররা প্রতিনিয়ত হতাশায় ভুগছেন। করোনা চলাকালীন  চাকুরির নির্ধারিত বয়সসীমা পেরিয়ে গেছে অনেক নিয়োগপ্রার্থীর। এমনকি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েও করোনার কারণে যোগদান করতে পারছেন না অনেকেই।

সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে বিনীত নিবেদন আপনারা  এহেন সংকটে এসকল শ্রেণি পেশার মানুষের প্রতি আরও বেশি আন্তরিক হয়ে কাজ করুন। আপনাদের একটি সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারে অনেকের জীবন; থামিয়ে দিতে পারে অনেকের ক্রন্দন। আর এ ক্রন্দন যদি থামানো না যায় তাহলে এ ক্রন্দনের দাবদাহের প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তরে আলোড়ন সৃষ্টি করবে। যা উন্নয়নশীল ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য কাম্য নয়।

সর্বোপরি দেশের এহেন সংকট মোকাবিলায় মানবিক আচরণ একান্তভাবে কাম্য ।

লেখক:  লিজা আক্তার, সহকারী শিক্ষক, ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুল, ঢাকা।