যেকোন দেশের উন্নতির অন্তরালে থাকে সেখানকার শিক্ষা-দীক্ষা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি। যথার্থ শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি বিশ্ব দরবারে শির উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। তাই যখন কোন জাতি শিক্ষাকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করে, সেখানকার সার্বিক অবস্থা সহজে রুগ্ন হয় না। পৃথিবীর ইতিহাসে অস্ত্র যেখানেই শত্রুতা তৈরি করেছে, জ্ঞান সেখানে বন্ধুত্বের জানালা খুলে দিয়েছে। একটি জাতিকে দাঁড় করাতে অর্থনৈতিক অগ্রসরতার প্রয়োজন হয় না, আকাশচুম্বী ইমারত লাগে না, লাখ লাখ সেনাবাহিনী কিংবা পারমাণবিক বোমা লাগে না। একটি জাতিকে দাঁড় করাতে প্রয়োজন কিছু পৃথিবী বদলে দেয়া মানুষ; যাদের মেধার হুংকার ও স্বচ্ছ প্রতিযোগিতায় চুরমার হয়ে যাবে সকল অনৈতিক কার্যক্রম। এজন্য ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র মেধাকে নিয়মিত পরিচর্যা করে। এর মাধ্যমে দেড়শ’ কোটি মানুষের দেশ চীন জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করছে। ১২০ কোটি মানুষের দেশ ভারত তরুণদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে। প্রকৃতপক্ষে যে দেশ যেটির কদর করে, সে দেশ সেটিই অর্জন করে। আমরা পেয়েছি দেশভর্তি নেতা আর পশ্চিমারা পেয়েছেন পৃথিবী জয় করা মানুষ। আমরা অধিকাংশই নিজের স্বপ্নের পিছে না ছুটে তুচ্ছ মানুষের পেছনে স্লোগান দিয়ে যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময় নষ্ট করি। আমরা ক্ষমতাকে ব্যবহার করি নিজের জন্য কিন্তু উন্নত বিশ্ব সেটি করেন সমাজের জন্য। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নেতারা দখল করা তো দূরের কথা মেধাবীদের ভয়ে নেতারা পর্যুদস্ত। এজন্য নেতাদেরকে বটবৃক্ষ মনে না করে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলুন।
পৃথিবীর সবকিছু উদ্ভাবন হয় মেধাবীদের দ্বারা আর মেধাবীদের তৈরি করেন শিক্ষকরা। তাই তাদের যোগ্যতার মাপকাঠি হওয়া চাই একদম যথার্থ। এজন্য উন্নত বিশে্ব পিএইচডি ও পোস্টডক ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায় না। সেখানে শিক্ষক হওয়ার পূর্বশর্ত হলো ‘গবেষণায় কৃতিত্ব’। কারণ গবেষণার অভিজ্ঞতা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সম্ভাবনাময় মানুষগুলো। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে কম অগ্রাধিকার দিয়ে রাজনৈতিক মতাদর্শ, শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য বা স্বজনপ্রীতির প্রশ্রয়ে নিয়োগের ঘটনা বেশি হয়ে থাকে। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষকই রাজনীতি করার জন্য ক্লাস করানোর সময় পান না। কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রতি তার যে দায়বদ্ধতা সেটি সম্পন্ন না করে, তিনি যতই মহাব্যস্ত থাকেন না কেন, তাতে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয় না। বেশি ফল ধরা বৃক্ষ যেমন নুয়ে পড়ে তেমনি পৃথিবীর প্রকৃত প্রজ্ঞাবান শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের প্রতি বিনয়ী ও সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখান। কিন্তু এদেশের অনেক শিক্ষকেরই পৃথিবীর যত বীরত্ব, সেটা শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই দেখাতে হয়। কেউ কেউ আবার জ্ঞানের দিক থেকে চলন্ত বিশ্বকোষ কিন্তু কার্যক্ষেত্রে চরম ব্যর্থ। তবুও প্রতিটি শিক্ষক যদি তাদের প্রকৃত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাটুকু শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিত তাহলে হাজারো সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতো।
আমাদের স্কুল জীবনেই ‘সময়ের মূল্য’ রচনা পড়ানো হয় অথচ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সেশনজটের নামে বৃথা কালক্ষেপণ করানো হয়। যে বয়সে আমাদের পরিবারের হাল ধরার কথা, জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখার কথা তখন আমরা হতাশা ও নিরাশায় মাথা ঝুঁকিয়ে রাখি। সেশনজটের মতো হতাশাজনক বিষয় উন্নত বিশে্বর কোথাও নেই। কিন্তু আমাদের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে মহামূল্যবান সময় যেটি রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাকর বিষয়। মাঝেমাঝে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও বাস্তব চাহিদা তুলনামূলক বিবেচনা করলে মনে হয় ‘পুরো শিক্ষাজীবনটায় একটি সেশনজট!’ সারা দুনিয়ার তরুণেরা গড়ে ২৬-২৭ এর মধ্যে পিএইচডি শেষ করেন। সে বয়সে আমাদের দেশের বহু শিক্ষার্থী স্নাতক সম্পন্ন করতে পারেন না। যে সমাজে তরুণদের অবস্থা এমন সে সমাজ কখনও মাথা তুলে বিশ্বদরবারে দাঁড়াতে পারে না। দেশের অভ্যন্তরীণ শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়ন না করলে আমরা বনসাইয়ের মতো বুড়ো হবো ঠিকই, বিকশিত হতে পারবো না।
বিশ্বায়নের এই যুগে একটি মেধাবী মনই একটি দুর্গ। কিন্তু আমরা সম্ভাবনাকে খুঁজতে জানি না বরং সম্ভাবনাকে অবহেলায় পরিণত করি। সহজাত মেধাকে বের করতে হলে কাউকেই অবহেলা করা যায় না। আমরা যে শিক্ষার্থীকে একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা সরকারি কর্মকর্তা বানাতে চাচ্ছি, সে হয়তো এর চেয়ে অনেক বড় কিছু হওয়ার যোগ্যতা রাখে। সে সম্ভাবনাকে কি আমরা বের করে আনার চেষ্টা করি? কোন প্রতিভা বিকশিত না হলে, শুধু একটি পরিবার নয়, নতুনত্ব থেকে পুরো পৃথিবী বঞ্চিত হয়। কূপমন্ডুকের মতো জলাশয়কে যারা মহাসাগর ভেবে দিন কাটায় সেসব রেজাল্টধারী মেধাবীদের নিয়েই আমরা সন্তুষ্ট থাকি। অথচ এদের ভিড়ে কত প্রতিভাবানদের আমরা হত্যা করি, সেটা কি আমরা উপলব্ধি করি? এমন অনেক শিক্ষার্থী আছেন যাদের মানসম্মত সিজিপিএ নেই কিন্তু ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তা এবং বিশ্লেষণ করার প্রচন্ড ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমরা এই ধরণের মেধাবীদের যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারি না। কিন্তু যারা গবেষক হওয়ার প্রক্রিয়াটুকু সম্পর্কেও অবগত নন শুধু ভালো সিজিপিএ পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকেন সেসব শিক্ষার্থীদের গবেষণার সুযোগ দেওয়া হয়ে থাকে। এই সর্বোচ্চ সিজিপিএ-নির্ভর গবেষণার সুযোগ দিলে তো রাষ্ট্র সর্বদিক থেকে ব্যাধিগ্রস্ত হবেই।
উন্নত বিশে্ব কোন রকম রাজনৈতিক ও ব্যক্তি প্রভাব ছাড়াই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে মেধাবী ও যোগ্য গবেষকদের। সেসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে পর্যাপ্ত আধুনিক সুবিধা সম্বলিত ল্যাব। রাষ্ট্র তাদের গবেষণাকর্মের জন্য যথেষ্ট সহায়তা প্রদান করেন। আমাদের মতো টিউশনি করে তাঁদের সময় নষ্ট করতে হয় না। কিন্তু আমাদের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ল্যাব থাকা তো দূরের কথা গবেষণা প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত নন বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা। এছাড়া আমরা জন্মকে কর্মের চেয়ে বড় করে দেখি ফলে কর্মস্পৃহা মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে। কারণ এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে প্রায় পঁচিশ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে। এভাবে আমরা সম্ভাবনাকে গলাটিপে হত্যা করি। মূলত মাপকাঠি যেখানে নড়বড়ে, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা সেখানে স্বপ্নমাত্র।
আমাদের অনেকেই ব্যক্তি আদর্শ এবং দেশপ্রেমের বুলি আওড়ায় অথচ কার্যক্ষেত্রে চরম নিস্ক্রিয়। আচ্ছা পশ্চিমের শিক্ষক-গবেষকরা কি দেশকে ভালোবাসেন না? তারা নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। তারা এর জন্য ওয়াশিংটনের ছবি গলায় ঝুলিয়ে প্রদর্শন করে বেড়ান না। তারা বরং কাজের নেশায় ওয়াশিংটনকেই ভুলে যান। তারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক বলেই নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে যাচ্ছেন। অথচ আমরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমাগত একের পর এক দিবস পালন কিংবা তথাকথিত দেশপ্রেমিক সাজার প্রত্যয়ে রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার নেশায় মেতে উঠি। ব্যক্তিপূজা না করে তার আদর্শকে বাস্তবায়ন করার নেশায় স্ব স্ব স্থান থেকে সবাই সোচ্চার হলে দেশটা সত্যিই এতদিন সোনার বাংলা হয়ে যেত। এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতাই আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। সবাই ব্যস্ত নিজের উদ্দেশ্য হাছিল ও ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখানোর জন্য; যেখানে জাতীয় উদ্দেশ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিতান্তই অপ্রতুল।
বিশ্ব রাজনীতিতে ‘দা-কুমড়া’ সম্পর্কের দেশ ইরান-আমেরিকা। এমনকি ইরানের ভূখন্ডে আমেরিকার দূতাবাস পর্যন্ত নেই। তবুও ইরান থেকে হাজার হাজার গবেষক আমেরিকাতে আসেন। চীন-আমেরিকা বর্তমান বিশে্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও সামরিক শক্তির দিক দিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতার দেশ। অথচ চীন থেকে প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার তরুণ-তরুণী শুধু আমেরিকায় যান গবেষণার জন্য। আমেরিকার সাথে বৈরী মনোভব হলেও ভালো বিষয়গুলো ধার করতে ওরা কার্পণ্য করে না। কারণ শত্রুর কাছ থেকেও ভালো কিছু শেখা যায়। অথচ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে ভিন্ন।
চীনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র মেধাবী ছেলেমেয়েদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অনেক প্রকল্প চালু করেছে। তার মধ্যে চীনের জনপ্রিয় একটি প্রকল্প হলো ‘সহস্র মেধাবী প্রকল্প’। অথচ আমরা মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে পারি না। রাষ্ট্র এর জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ কি নিয়েছেন? উন্নত রাষ্ট্রে বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিকশিত হতে পারেন অথচ স্বদেশে পারেন না। তবুও তাদের একাংশ দেশের প্রতি মমত্ববোধের দৃষ্টিকোণ থেকে দেশে ফেরত আসলেও তাদের যথার্থ মূল্যায়ন আমরা করতে পারি না। বিশ্ববিখ্যাত জার্নালে গবেষণা প্রকাশিত হলেও দেশে অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার আবেদনের যোগ্যতা থাকে না, ছোট্ট একটি চাকরির জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে চারিত্রিক সনদের জন্য দৌড়াতে হয়; তখন স্বভাবতই তারা দেশে ফিরতে চাইবে না এটায় স্বাভাবিক। অপ্রিয় সত্য হলেও অনেক ক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক অযোগ্যদের মধ্যেও অনেকের বেকার জীবনযাপনও করতে হতে পারে। এভাবে আমরা যোগ্য মানুষকে যোগ্য স্থানে না বসিয়ে জাতীয় সম্পদ ধ্বংসের মুখে ফেলছি। দেশের মেধাবীদের এভাবে আর কত যুগ দূরে রাখব আমরা! রাষ্ট্র যদি তাদের সামান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে নিতে না চায়, তাহলে নিজ ভাগ্যকে হত্যা করে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দিলে ভাগ্য পরিবর্তন হবে না।
পৃথিবীতে যেসব দেশ এগিয়ে, তাদের গবেষণায় বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি। অথচ বাংলাদেশে গবেষণা খাতে বরাদ্দ নিতান্তই নগণ্য। ভারতের শিক্ষা ও গবেষণার সার্বিক মান আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ভারত তার দেশের গবেষণার জন্য দিনে দিনে যেমন বাজেট বৃদ্ধি করছে, তেমনি তা যথাযথ ব্যবহারের জন্য মেধাবী লোকবলও নিয়োগ দিচ্ছে। সিঙ্গাপুর তাদের জিডিপির ২.২ শতাংশ খরচ করে গবেষণায়। তারা জানে, উদ্ভাবনে সেরা হওয়ার মানেই হলো দুনিয়ার সেরা হওয়া। আমরা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে পারি, হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কিনতে পারি, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন লালন করতে পারি, হাজার হাজার কোটি টাকা আমদানি-রফতানি করতে পারি অথচ শত কেটি টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে যোগ্য শিক্ষক, গবেষক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী এনে নিজের দেশের শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের সুযোগ তৈরি করতে চাই না। এই হলো আমাদের দূরদর্শিতা! একটা নগর ডুবির চেয়ে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান কমে যাওয়া অনেক উদ্বেগের! আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কি আমরা করে জেনেশুনে খুন করছি! যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য ও পাঠ্যদান ব্যবস্থা যুগোপযোগী করার পাশাপাশি ব্যাপক গবেষণা কার্যক্রম শুরু করা যায়, তাহলে শিক্ষার্থীদের গৌরবের সৌরভে মোহিত হবে বিশ্ব।
লেখক : মো. আশিকুর রহমান, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।