একুশ মানে এক ঝাঁক তরুণের তাজা রক্ত। সালাম, রফিক, বরকতসহ অজানা অনেক ভাষা শহিদ বায়ান্নতে যে পথচলার সূচনা করেছিলেন, সে পথ ধরেই এগিয়েছে ৬৯-এর গণ-আন্দোলন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। যার চূড়ান্ত প্রাপ্তি আমাদের বহু আকাঙ্খিত স্বাধীনতা স্বপ্নের স্বদেশ-স্বাধীন বাংলাদেশ। এদেশের স্বাধীনতার শত্রুরা তাদের পরায়ের গ্লানি ভুলতে পারেনি। তাই বার বার নানা চক্রান্ত্রের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতাকে বিতর্কিত করতে চায়। স্বাধীনতার পর লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি বিপন্ন করেছে তারা। অবশেষে পচাঁত্তরের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নির্মম হত্যাকান্ডের পর পুনরায় তারা ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে। স্বাধীনতার ঘৃণ্য শত্রু শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রীসহ মুক্তিযুদ্ধের বিশ্বাসঘাতকদের মন্ত্রী বানিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য বিকৃত করে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। আজও স্বাধীনতার সেই ঘৃণ্য শত্রুরা সর্বাগ্রে জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে বর্তমান সরকারের তোষামোদ করে ক্ষমতার অভ্যন্তরে বহাল থেকে তাদের কুকর্ম করে যাচ্ছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব নিয়াজউদ্দিনকে দেখেছি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে জয়বাংলা, বঙ্গবন্ধু, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর গুনকীর্তন গেয়ে বহাল তবিয়তে দুর্নীতি করে গেছেন। আজও শীর্ষ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধদের কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন স্তরে স্বাধীনতা বিরোধী ঘৃণ্য শত্রুরা সরকারের ছত্রছায়ায় বহাল তবিয়তে বাঙালি জাতির গর্ব মহান একুশের অহংকারে বার বার আঘাত হানছে। পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বীজ ছড়িয়ে বর্তমান সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশাল অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। পাঠ্যবইয়ে ইচ্ছাকৃত ভুল করে সে ঘৃণ্যচক্র আজ মাথা উঁচু করে সরকারের কাছের লোক হিসেবে সিনাটান করে গর্বের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। বেসরকারি বা কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলো ৪-৬ বছর বয়সী শিশুদের ইংরেজি বা আরবি ভাষায় কঠিন কঠিন শব্দ শিখিয়ে সাহেব বা ধার্মিক তৈরি করার অশুভ চক্রান্তে রত। নোট গাইড ও কোচিং সেন্টারের ব্যাপক প্রসরতা পাঠ্য বই ও সৃজনশীল শিক্ষাকে ধ্বংশ করে দিচ্ছে।
এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কানে সীসা, চোখে রঙিন চশমা লাগিয়ে দিবানিদ্রায় মগ্ন আছেন। যা মহান ভাষা আন্দোলনের শহিদদের আত্মত্যাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। অপরদিকে প্রাথমিকের ছুটির তালিকার মাধ্যমে বিগত কয়েক বছর যাবৎ আগামি প্রজন্মকে জাতীয় দিবস পালনে বীতশ্রদ্ধ করে চলেছে। জাতীয় দিবসগুলো ছুটি দেখানে হয়। যার ফলে শিশু শিক্ষার্থীরা ছুটি ভোগ করে। শিক্ষকদের জাতীয় দিবস যথাযথ মর্যাদায় পালনের নির্দেশ থাকে। ছুটি থাকায় শিক্ষক ও ছাত্র হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর বা নাম ডাকার কোন সুযোগ থাকে না। শহরাঞ্চলে কোন কোন স্কুলে শিক্ষকরা কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে নির্দেশ মোতাবেক কিছুক্ষণ উপস্থিত থেকে সময় কাটান। ছুটি দেখিয়ে কাজ করতে নির্দেশ দেওয়ায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করে। শিক্ষার্থীরা জাতীয় দিবস তথা জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি তথা বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতহাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে বারবার জাতীয় দিবসের ৬ দিনকে কর্মদিবস ঘোষণা করার দাবি করলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি কাড়তে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষকদের অহেতুক যন্ত্রণা দিচ্ছে এই ছুটির তালিকা। তারা বেশি ছুটি দাবি করছে না। এই ছুটির তালিকা শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের অধিকার হরণ করছে। সকল সরকারি কর্মচারি ৩ বছর অন্তর অন্তর শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পায়। ছুটির তালিকায় গ্রীষ্মের ছুটি ১৫ দিন না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষকেরা ৪/৫ বছর পর শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পান। শিক্ষকেরা যদি অন্যান্য সরকারি চাকুরিজীবীদের মতো ৩ বছর পর পর শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পাবে এটাই স্বাভাবিক হওয়া উচিত। কিন্ত এখানেও সমস্যা সৃষ্টি করে কর্তৃপক্ষ। প্রাথমিক শিক্ষক তথা শিক্ষাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ঘাপটি মেরে সরকারের অভ্যন্তরে রয়েছে।
স্বাধীনাতার দীর্ঘ সময় পরেও স্বাধীনাতার ঘৃণ্য শত্রুরা ৫২-এর একুশের চেতনায় আঘাত হানছে। তারা শিশুদের পাঠ্যপুস্তক বিকৃত, ভুল অকার্যকর করে নোট গাইডের প্রসারতা বৃদ্ধি করছে। তারা শিশু-কিশোরদের জাতীয় দিবস ছুটি রেখে জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি থেকে তাদের দূরে রাখার অপতৎপরতায় লিপ্ত। প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষায় চরম দুর্নীতি, শিক্ষা ব্যবস্থার বাহ্যিক উন্নতি হলেও শিক্ষক সংকটসহ নানা অব্যবস্থাপনা অনেকটা ‘উপর দিয়ে ফিটফাট, ভিতর দিয়ে সদরঘাট’ প্রবাদের মতো। বাঙালি জাতির গৌরবময় ইতিহাস বায়ান্ন একুশ। ভাষার জন্য কোন জাতিকে রক্ত দিতে হয়নি। ৬৯ এর গণ-আন্দোলন, ৯ মাসের স্বাধীনাতার যুদ্ধ। ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তে ও অনেক মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নববর্ষের উৎসবসহ অসংখ্য গর্বের বিষয় আছে। আগামি প্রজন্মকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সঠিক ইতিহাস জানানো প্রয়োজন। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ছুটি নিয়ে অধিকার হরণের প্রতিবাদে ২৩শে মার্চ ছুটির আগে প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরামের আহ্বানে সকল শিক্ষক সংগঠন একযোগে আধঘন্টা কর্মবিরতি পালন করবে। একুশের চেতনায় গড়ে উঠুক আগামি প্রজন্ম। দেশ থেকে দূর হোক সকল অন্যায় ও অত্যাচার। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তাদের মাঝে শুভবুদ্ধির উদয় হোক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে দূর হবে একুশের আর্তনাদ, এই প্রত্যাশাই রইল।
মো. সিদ্দিকুর রহমান: আহবায়ক প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরাক্ষা ফোরাম ও দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা