একুশ আসুক বিজ্ঞানচর্চার মশাল হাতে - দৈনিকশিক্ষা

একুশ আসুক বিজ্ঞানচর্চার মশাল হাতে

হরিপদ দত্ত |

৬৭ বছর। সময়ের হিসাবে কম নয়। ১৯৫২ থেকে ২০১৮। যেন একটা আয়নায় বাঁধানো সাদা-কালো পুরনো গ্রুপ ফটো। ফটোর ভেতর যে মুখগুলো, যা কিছুটা অস্পষ্ট, তাদের অস্তিত্ব হয়তো আজ পৃথিবীতে নেই। কিন্তু যা আছে, তা হচ্ছে স্মৃতি।

স্মৃতির ভেতর ইতিহাস। আসলে ইতিহাস কঙ্কালের মিছিল নয়, বরং নতুন ভোরের পুনরুত্থান। আমাদের একটি সত্যকে মানতে হবে যে, ভাষা-সভ্যতা ও ক্রমবিবর্তন নিয়ম মেনে চলে। যে কারণেই শব্দার্থেরও পরিবর্তন ঘটে। হাজার হাজার অর্থবিবর্তিত শব্দের মতো ‘রাজাকার’ বা ‘রামরাজ্য’ শব্দও প্রাচীন অর্থ বদলে নেতিবাচক রূপ নিয়েছে।

শব্দের মতো ঐতিহাসিক ঘটনারও সময়ের হাত ধরে প্রাসঙ্গিকতার বদল হয়। ধরা যাক, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ আর বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিকে। বাঙালিকে আজ আর ভাষাবিদ্রোহ বা মুক্তিযুদ্ধের আবেগতাড়িত হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে না।

রক্ত আর অস্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতটা বদলে গেছে। নির্মম সত্য যে ভাষার লড়াই আর একাত্তরের যুদ্ধ শেষে কী করণীয়, সেই প্রশ্নের সামনে বাঙালি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। তাই তারা একুশকে রূপ দেয় ‘মেলা’য় আর ‘বই বাণিজ্যে’। এককথায় ‘বিনোদন’ আর ‘উৎসবে’ হারিয়ে যায় একুশ।

পৃথিবীর যেসব দেশে একুশ নেই, সেসব দেশই জ্ঞান, বিজ্ঞান আর আনন্দ চর্চার বাহন হিসেবে বই বাণিজ্যের হর্তাকর্তা। মনে রাখতে হবে, তাদের বইয়ের ভাষা ইংরেজি। বাঙালি সাহিত্যিক কিংবা বৈজ্ঞানিকরা ইংরেজি ভাষাটা সেভাবে দখলে আনতে পারেননি আজও।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন কৌতূহলের সঙ্গে বিষয়টি খেয়াল করেছেন। একুশে বাঙালিরা বই লিখবে, প্রকাশ করবে তাতে অসুবিধের কিছু নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল- কী বই লেখেন? কবিতা আর গল্প, উপন্যাসে ছয়লাব। প্রবন্ধ কই, চিন্তাশীল প্রবন্ধ? বিজ্ঞান কই? দর্শন কই? জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র বদলের ওই যে তৃষ্ণা, তা কি ছিল না একুশ বিদ্রোহে?

বিজ্ঞান আর দর্শনচর্চার পরিপ্রেক্ষিত তো নির্মাণ করে দিয়েছে বায়ান্নর একুশ। আজকের একুশের দর্শন তো সমাজ বদলানোর দর্শন। সময়ের বিবর্তনে আজকের একুশের মর্মার্থ হচ্ছে মানুষের মুক্তির সাধনা, সেই সাধনার জন্য চাই আধুনিক জ্ঞানচর্চা।

আনন্দ উৎসব তো থাকবেই। একুশ মানে তো স্মৃতিকে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা আর শোক-কান্না করা নয় শহীদের জন্য। আজকের একুশ হচ্ছে শহীদের রক্তের মূল্য দেয়া। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য- একুশে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের শ্রেণীটা কী ছিল? তারা কি শিল্পপতি-ব্যবসায়ী কোটিপতির সন্তান ছিলেন?

শ্রেণী হিসেবে তারা ছিলেন দরিদ্র নিুমধ্যবিত্তের সন্তান। মাতৃভাষাকে সামনে রেখে তাদের সংগ্রামের অনুপ্রেরণাটা ছিল মানুষের অর্থনৈতিক আর মধ্যযুগীয় বোধ-বিশ্বাস থেকে মুক্তি। একুশের বহির্কাঠামো ছিল ভাষা-সংস্কৃতি, অন্তর্কাঠামোর দর্শনটা ছিল মানবমুক্তি।

একুশের মিছিলে বহন করা, প্লাকার্ড, ফেস্টুন-ব্যানারের ভাষাটা ছিল একেবারেই আলাদা। সেই দিনের সংগ্রাম, বিপ্লব, প্রতিবাদ আর মনের বাসনার চিত্রটা ছিল একেবারেই ভিন্ন। একুশ চেতনার অনেক কিছুই পূর্ণ হয়েছে বাঙালির, অপূর্ণতার হিসাবটাও ছোট নয়। ভৌগোলিক আকৃতির বদল হয়েছে।

নগর বড় হয়েছে, উপশহর তৈরি হয়েছে, গ্রাম বদলেছে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল-চিকিৎসালয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ধর্মীয় প্রার্থনালয়। যা বাড়েনি তা হচ্ছে আধুনিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা। প্রকাশনার জগতে বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে, উন্নতমানের কাগজে আধুনিক ছাপাখানার বই তৈরি হচ্ছে।

কিন্তু পিছিয়ে পড়েছে, খুবই পিছিয়ে পড়েছে- চিন্তাশীল আর সৃষ্টিশীল রচনা। গবেষণাটা হচ্ছে না একেবারেই। সাহিত্য হোক, বিজ্ঞান হোক, দর্শন হোক, সমাজ-রাষ্ট্রচিন্তা হোক, আন্তর্জাতিকমানের গবেষণাচর্চাটা একেবারেই হচ্ছে না। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে, গবেষণায় দিতে হবে অর্থের জোগান।

একুশের শহীদদের নামের ওপর আনতমাথা রেখে শুধু প্রত্যাশা করি বাঙালির মুক্তি ঘটুক তার অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি আর চেতনা-চৈতন্যের। একুশের তারুণ্যের কাছে একুশ হোক বাঙালির এক অদ্বিতীয় মহাচৈতন্যের দর্শন। কেবল ভাষা নয়, রাষ্ট্রভাষা নয়, ভাষার গভীরে লুকিয়ে থাকে যে সভ্যতার আর সৃষ্টিশীলতার মহাপ্রাণ প্রমিথিউসের অগ্নি, তার হোক মহা উত্থান। একুশ আসুক বিজ্ঞানচর্চার মশাল হাতে।

অনুলিখন : শুচি সৈয়দ

সুত্র: যুগান্তর

স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040621757507324