চারতলা একটি অপরিসর ভবন। তাও ভাড়া করা। সামনের অংশে লেখা ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। এখানেই উচ্চশিক্ষা নিতে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর আসা-যাওয়া। তাদের ক্লাস-পরীক্ষায় বরাদ্দ ভবনের মাত্র সাড়ে ১০ হাজার বর্গফুট জায়গা। পাঠদানে শিক্ষক রয়েছেন ৬০ জন, তবে কাগজে-কলমে। বাস্তবে শিক্ষক সংখ্যা সর্বোচ্চ ৩৫। আর ২০ বর্গফুটের একটি কক্ষে কয়েকটি চেয়ার ও বুক শেলফ বসিয়েই বলা হচ্ছে গ্রন্থাগার। বিশ্ববিদ্যালয়টির সব ধরনের আর্থিক কর্মকাণ্ডই চলছে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) চেয়ারম্যান ও একজন সদস্যের স্বাক্ষরে। রোববার (৭ এপ্রিল) বণিক বার্তায় প্রাকশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাইফ সুজন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা সড়কে পৌর কলেজপাড়া এলাকায় ভাড়া করা ভবনে ২০১২ সাল থেকে কার্যক্রম চালাচ্ছে ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের প্রায় সবই লঙ্ঘিত হচ্ছে এখানে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ৪৪ ধারা অনুযায়ী দেশের প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাধারণ তহবিল থাকবে। এ তহবিলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়কৃত বিভিন্ন বেতন-ফি ও অন্যান্য উেসর অর্থ জমা হবে। এ তহবিলের মাধ্যমেই এসব অর্থ ব্যয় করতে হবে। বোর্ড অব ট্রাস্টিজ মনোনীত একজন কর্মকর্তা ও ট্রেজারারের যৌথ স্বাক্ষরে এ তহবিল পরিচালনা করতে হবে। এ আইনের তোয়াক্কা করছে না ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ড।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির লেনদেনসহ অর্থসংক্রান্ত সব ধরনের হিসাব পরিচালিত হয় ট্রাস্টি বোর্ডের দুই সদস্যের স্বাক্ষরে। তারা হলেন, বিওটি চেয়ারম্যান সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার এমপি ও রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার। সম্পর্কে তারা ভাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইমরোজ মুহাম্মদ শোয়েব বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেজারার স্যার আছেন। প্রাথমিকভাবে তিনি আর্থিক বিষয়গুলো দেখভাল করেন। চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজগুলো সম্পাদিত হয় বিওটির চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টও তাদের যৌথ স্বাক্ষরেই পরিচালিত হয়। বিশেষ করে ভাইস চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার সার্বিক বিষয় তদারক করেন ও নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় দেন।
বেতন-ভাতাসহ বড় লেনদেনগুলো চেয়ারম্যান ও তার স্বাক্ষরে পরিচালিত হওয়ার কথা স্বীকার করেন বিওটির সদস্য রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার। তবে ছোটখাটো লেনদেনগুলো ট্রেজারার করেন বলে জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থ বিভাগে কোনো পরিচালকই নিয়োগ দেয়া হয়নি। জানা যায়, কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়ে অর্থ বিভাগের পরিচালকসহ কয়েকটি পদে নিয়োগের তাগিদ দেয় ইউজিসির একটি প্রতিনিধি দল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এক চিঠিতে ইউজিসিকে জানানো হয়, নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। যদিও এখন পর্যন্ত এসব পদে নিয়োগ হয়নি।
মৌলিক অবকাঠামোরও বেশির ভাগ অনুপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। আলমডাঙ্গা সড়কে যে ভাড়া করা ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, তার আয়তন ১০ হাজার ৫৩০ বর্গফুট। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ৬-এর ৩ উপধারা অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য কমপক্ষে ২৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের ফ্লোরস্পেস থাকতে হয়। কয়েকটি চেয়ার-টেবিল ও বুক শেলফ সাজিয়ে যে গ্রন্থাগার, তার আয়তনও ২০ বর্গফুটের বেশি নয়।
সহকারী গ্রন্থাগারিক হিসেবে কাজ করছেন নিলুফা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকায় জায়গার কিছুটা সংকট রয়েছে। তবে স্বল্প পরিসরে হলেও সেবা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের গ্রন্থাগারে অংশগ্রহণ কিছুটা কম। গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা চার হাজারের কাছাকাছি।
সংকট রয়েছে গবেষণাগারেরও। এটি সমাধানে কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নির্দেশনা দেয় ইউজিসি। এতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামের ল্যাবরেটরিতে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে যন্ত্রপাতি সংযোজন ও অবকাঠামো উন্নয়নের কথা বলা হয়। পাশাপাশি কৃষিবিষয়ক প্রোগ্রামে মাঠ পর্যায়ের ল্যাবরেটরি কার্যক্রমের জন্য খামার সুবিধা সংযোজনের কথা বলা হয়। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এক চিঠিতে ইউজিসিকে জানানো হয়, নির্দেশনার আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যদিও সরেজমিন গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কোনো গবেষণাগারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাফেটেরিয়া, প্রার্থনা কক্ষ ও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আলাদা কমন রুম কিংবা খেলাধুলার কোনো সুবিধা নেই।
এ বিষয়ে ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ইউনিভার্সিটি লাইফ নিয়ে অনেক গল্প শুনতাম। পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকার কথা। কিন্তু এখানে ক্লাস-পরীক্ষার বাইরে আর কোনো ব্যবস্থা নেই। স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ব্যবধান খুঁজে পেলাম না। বরং স্কুল-কলেজ লাইফে আরো বেশি সুযোগ-সুবিধা থাকে।’ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক রয়েছেন ৬০ জন। আর শিক্ষার্থী ৪১৮ জন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে শিক্ষকের সংখ্যা ৩৫-এর বেশি হবে না।
প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এ শিক্ষকদের মধ্যেও বেতন-ভাতা নিয়ে রয়েছে চরম অসন্তোষ। পূর্ণকালীন শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক পদে সর্বসাকল্যে বেতন ৫০ হাজার টাকা। সহযোগী অধ্যাপক পদে ৩০ হাজার ও সহকারী অধ্যাপক পদে ২০ হাজার এবং প্রভাষক পদের একজন শিক্ষকের বেতন মাত্র ১৫ হাজার টাকা। আর খণ্ডকালীন শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক পদে ২৫ হাজার, সহযোগী অধ্যাপক পদে ২০ হাজার, সহকারী অধ্যাপক পদে ১৫ হাজার এবং প্রভাষক পদে মাত্র ১০ হাজার টাকা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন অফিস সহকারীর বেতন ১২ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে আইন বিভাগের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে অনুপাতে বেতন-ফি আদায় করা হয়। শিক্ষকরা সে অনুপাতে বেতন পান না। কারো কাছে বেতন বিষয়ে বলতেও পারি না। এ কারণে শিক্ষকরা বেশিদিন থাকেনও না এখানে। যোগ দেয়ার কয়েক মাস পরই অন্যত্র চলে যান।’
ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে বিভিন্ন খাতে ফি নেয়ার অভিযোগ করেছেন প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, মোটা অংকের অর্থ আদায় করলেও গুণগত মানের শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সিএসই বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্নকারী এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নামে-বেনামে বিভিন্ন খাত দেখিয়ে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অথচ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো থেকে শুরু করে যোগ্য শিক্ষক—কোনোটিই নেই শিক্ষার্থীদের জন্য। সিএসইর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে শিক্ষক ছিলেন মাত্র তিনজন। তা-ও সবাই লেকচারার। ল্যাব পরীক্ষা, থিসিসসহ নানা অজুহাতে টাকা নেয়া হয়েছে। অথচ এসব কাজে আমরা কোনো সহযোগিতা পাইনি।’
যদিও এসব অভিযোগ আংশিক সত্য বলে জানান বিওটির সদস্য রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার। তিনি বলেন, ‘গবেষণাগার রয়েছে, কিন্তু সীমিত। যানবাহন সুবিধা নেই। তবে বিষয়টি আমরা বিবেচনা করছি। আসলে মফস্বল শহরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চালানো অনেক কঠিন। এখানে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে অনেক ছাড় দিতে হয়। আমরা জনপ্রতিনিধি হওয়ায় অনেকেই ছাড়ের জন্য আসে। আয় কম হওয়ায় শিক্ষকদের বেতনও কিছুটা কম দিয়ে শুরু করি। তবে এরই মধ্যে শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বছরের শুরুতেও ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়েছে।’
নানা অব্যবস্থাপনা, অনিয়মের পাশাপাশি ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্ষদগুলোও নিষ্ক্রিয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির সিন্ডিকেটের সর্বশেষ সভা হয়েছে ২০১৬ সালে। অর্থাৎ দুই বছরের বেশি সময় ধরে গুরুত্বপূর্ণ এ পর্ষদের কোনো সভা হয় না। অন্য সভাগুলোও অনিয়মিত বলে জানান প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।
সার্বিক বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘ফার্স্ট ক্যাপিটাল নয়; দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বড় অংশেরই বেহাল দশা। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা আরো নাজুক। দূরত্ব ও ইউজিসির জনবল সংকটের কারণে এসব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত পরিদর্শন করা সম্ভব হয় না। এ সুযোগে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিরা যেখানে তদারকি করবে, উল্টো তারাই আইন ভাঙছে এটি আমাদের জন্য খুবই হতাশার।’