এবার ঈদুল আজহার সময় কোরবানির পশুর বাড়তি চাহিদা মেটাতে ভারত থেকে গরু আনতে দেবে না সরকার। স্থানীয় খামারিরা যাতে গরুর ভালো দাম পান সেজন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য বছর কোরবানির আগে সীমান্তে 'বিট খাটালের' মাধ্যমে গরু কেনাবেচা হয়েছে। এবার ঈদের আগে সীমান্তে এই প্রক্রিয়ায় গরু আনার অনুমতি দেয়নি সরকার।
গতকাল সোমবার শিল্প মন্ত্রণালয় অনলাইনে আয়োজিত 'চামড়া শিল্পের উন্নয়নে সুপারিশ প্রদান ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন টাস্কফোর্সের' দ্বিতীয় সভায় এ তথ্য জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (আনসার ও সীমান্ত) মো. শাহেদ আলী। তিনি বলেন, কোরবানিকে কেন্দ্র করে ভারত থেকে অবৈধ গবাদি পশু আসা এবং কোরবানির পশুর চামড়া চোরাচালান প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঈদের দিন ও পর দিন চামড়া নিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং গুজব ছড়ানো বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হবে।
সভায় বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীন আহমেদ জানান, আগামীকাল বুধবার বৈঠক করে চামড়ার দর নির্ধারণ করা হবে। ইতোমধ্যে ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন চামড়া মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে সুপারিশ করেছে।
প্রসঙ্গত, বিট খাটাল হলো একটি খোঁয়াড়ের মতো স্থান। ভারত থেকে আনা গরু এখানে জড়ো করা হয়। এরপর শুল্ক্ক কর্মকর্তারা মালিকানাবিহীন দেখিয়ে গরুগুলোকে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেন। এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে বাজেয়াপ্ত করার জন্য কাগজেকলমে সংক্ষিপ্ত বিচার দেখানো হয়। এরপর 'রাষ্ট্র্রীয় মালিকানাধীন বাজেয়াপ্ত' গরু মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে গরু ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। 'বৈধভাবে' ভারত থেকে গরু আনার এই ব্যবস্থা। তবে ভারতের কাছে এ ব্যবস্থার কোনো স্বীকৃতি নেই। এ প্রক্রিয়ায় বছরে ১৫ থেকে ২০ লাখ গরু দীর্ঘদিন এসেছে। ২০১৪ সালে ভারতে নরেন্দ্র মোদির সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গরু আসা কমেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশেও এখন বাণিজ্যিকভাবে পশুপালনও বেড়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, গত কয়েক বছরে ঈদুল আজহায় দেশে এক কোটি ১০ লাখের মতো পশু কোরবানি দেওয়া হয়। এর মধ্যে গরু-মহিষ থাকে ৪০ থেকে ৪৫ লাখ। এবার দেশীয় খামারিদের গরু দিয়েই চাহিদা মেটানোর পরিকল্পনা করছে সরকার।
করোনাকালীন এ সময়ে চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য কোরবানির পশুর চামড়া ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। তিনি বলেন, চামড়া খাতে সম্পৃক্ত ট্যানারি মালিক, আড়তদার, ক্ষুদ্র ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে চামড়া কিনে সংরক্ষণ করতে পারেন সেজন্য সরকার সহযোগিতা করবে। পাশাপাশি স্থানীয় ফড়িয়া, মৌসুমি ও সাধারণ ক্রেতাদের প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হবে।
সভায় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান ট্যানারি শিল্পের জন্য আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে অর্থ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়ে বলেন, হাজারীবাগে ট্যানারি মালিকদের জমি যদি রাজউক 'রেড জোন' তুলে নেয় তাহলে ট্যানারি মালিকদের ব্যাংক ঋণ পেতে সুবিধা হবে। তাদের ঋণ সহায়তা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে আসন্ন ঈদুল আজহায় চামড়ার পরিস্থিতির উন্নতি হবে না বলে তিনি আশঙ্কা করেন। তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকদের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আলাদা বৈঠক করে বিশেষ ঋণ সুবিধা নিশ্চিতের সুপারিশ তৈরি করা হবে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সমাধান দেবেন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, করোনাভাইরাসের দিকে খেয়াল রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করতে হবে। যাতে কোরবানির মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ না হয়।
শিল্প প্রতিমন্ত্রী বলেন, মাদ্রাসাগুলো বহুদিন ধরে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে জড়িত। কোরবানি উপলক্ষে মাদ্রাসাগুলোকে আর্থিক সহযোগিতা দিলে ঈদে চামড়া ব্যবস্থাপনায় সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ট্যানারি মালিকদের ঋণ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, এবার কাঁচা চামড়া ও লবণযুক্ত চামড়ার মূল্য আলাদাভাবে নির্ধারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যানারি মালিক ও কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ উন্নয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে এই খাতে আর্থিক সুবিধা দিতে সম্পৃক্ত মন্ত্রণালয় সুপারিশ দিলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হবে।
শিল্প সচিব কেএম আলী আজম বলেন, ঈদুল আজহার সময় তৃণমূল পর্যায়ে চামড়া ব্যবস্থাপনার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে প্রস্তুতি নিতে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অরিজিৎ চৌধুরী বলেন, ঈদুল আজহার আগেই ট্যানারি মালিকদের ঋণ সহায়তা নিশ্চিত করা হবে। বিসিকের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমেদ বলেন, দেশে পর্যাপ্ত লবণ মজুদ আছে, কোরবানিতে ঘাটতি হবে না।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন বলেন, আর্থিক নীতি সহায়তা ছাড়া এই দুর্যোগকালীন সময়ে চামড়া শিল্প বিপর্যয় কাটাতে পারবে না।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, বর্তমানে ট্যানারিতে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার চামড়া মজুদ আছে। এ অবস্থায় বিশেষ ঋণ সহায়তা নিশ্চিত করা ছাড়া অধিকাংশ ট্যানারি মালিকদের পক্ষে চামড়া কেনা সম্ভব নয়।