পরিচালনা পর্ষদ ও ম্যানেজিং কমিটি এবং এক শ্রেণির শিক্ষকের সমন্বয়ে সারাদেশে গড়ে উঠেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুনীর্তি ও লুটপাটের চক্র। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ও নামকরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পড়াশোনার মানের দিকে নয় এই চক্রটির টার্গেট আর্থিক খাতে। চক্রটি ভর্তি, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন খাত থেকে বছরে কম-বেশি হাজার কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা প্রতিবেদনও টাকা দিয়ে ‘ম্যানেজ’ করা যায়। তাই লুটপাট থামানো যাচ্ছেনা কোনোভাবেই।
সংশ্লিষ্টরা দৈনিক শিক্ষাকে বলছেন, শিক্ষা বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রণীত বেসরকারি স্কুল-কলেজ মাদরাসা ব্যবস্থাপনা কমিটি (এসএমসি) ও গভর্নিং বডি (জিবি) পরিচালনা বিধিমালায় সভাপতিসহ পর্ষদকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কর্মকাণ্ডের দায়ভার থেকে তাদের দেয়া হয়েছে মুক্তি। যে কারণে বৈধ-অবৈধ সব ধরনের নির্দেশ মানতে হয় প্রতিষ্ঠান প্রধানকে। কমিটির হাতেই চাকরির ভাগ্য রাখায় সবই শুনতে হয় প্রধান শিক্ষক, সুপার ও অধ্যক্ষকে। আবার কমিটির নির্বাচিত সদস্য হলেও সবার পক্ষে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার উন্নয়নে অবদান রাখার যোগ্যতা থাকে না।
অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান প্রধান স্কুল, মাদরাসা ও কলেজের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা হওয়ায় সভাপতি বা পর্ষদের অবৈধ ও অন্যায় নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আইনগতভাবে ফেঁসে যাচ্ছেন। আর কোনো কারণে প্রতিবাদ করলে চাকরিচ্যুত হওয়ার পাশাপাশি অপমান-অপদস্থ হতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে উভয় সংকটে আছেন তারা। অবশ্য কমিটির লোকজনকে ব্যবহার করে একশ্রেণির প্রতিষ্ঠানপ্রধানের বিরুদ্ধেও নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আবার যারা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধান পদে নিয়োগ পেয়েছেন তারা পরিচালনা কমিটির সাথে যৌথভাবে চক্র গড়ে তুলে লুটপাটে নিমজ্জিত হচ্ছেন। সাধারণ শিক্ষকরা তাদের ওপর মহাখাপ্পা। দৈনিক শিক্ষার কাছে এমন অভিযোগ হাজার হাজার।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরিচালনা কমিটির দুর্নীতিবাজ সভাপতি ও সদস্যরা নানা রকম অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কেনাকাটা ও শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের কাজকে গুরুত্ব দেন। বিপরীতে শিক্ষার মান কিংবা শিক্ষার্থীদের সমস্যার প্রতি তাদের নজর দিতে দেখা যায় খুব কম। বরং শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বাবদ আদায় করা অর্থ অযথা বৈঠক করে সম্মানী গ্রহণসহ নানাভাবে লুটপাটের অভিযোগ উঠছে প্রায়ই।
ভর্তি বাণিজ্য ও একাডেমিক ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগও কম। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানে দলাদলি করে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট, শিক্ষক-কর্মচারী-অভিভাবকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। আবার একশ্রেণির টাউট অভিভাবকও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে বেড়ায়। তাদের সন্তানদের ফাউ কোচিং না করালে পত্রিকা/টিভিতে ওই শিক্ষকের নামে কোচিং বাজ তকমা লাগানোর হুমকি দেয়া হয়। নিজেদের ছেলেমেয়েকে সারাবছর ফ্রি পড়িয়েছে আবার টেলিভিশনের টকশোতে গিয়ে কোচিংয়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। আবার আদালতে কোচিংয়ের বিরুদ্ধে রিটও করেন তারাই। কেচিং থেকে অবৈধ সুবিধা নেয়ার তথ্য ফাঁস করে দেয়ায় ভবঘুরে অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কমিটির বিরুদ্ধে আরও আছে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের অভিযোগ। বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, অনিয়মকারী সভাপতি ও সদস্যদের কমিটি থেকে বাদ দেয়াই এখন পর্যন্ত বড় শাস্তি। এজন্য ফৌজদারি বিচারের মুখোমুখি করার দৃষ্টান্ত আছে কমই। কমিটির প্রবিধানমালায়ও তাদের ধরার সুযোগ নেই বললেই চলে।
বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিবাজরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। যেমন- রাজধানীর শেখ বোরহান উদ্দিন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ ও উইলস লিটল স্কুলের সভাপতির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠায় তদন্ত হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। তবু ওই প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেই সভাপতি রাখার পক্ষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড।
সম্প্রতি রাজধানীর মতিঝিল মডেল স্কুল ও কলেজের সভাপতির নানা অন্যায়-অনিয়ম ও লুটপাটের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন শিক্ষকরা। আন্দোলনের মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শেষ পর্যন্ত ওই সভাপতিকে সরিয়ে দেয়। শিক্ষকদের অভিযোগ, ১০ বছরে স্কুলের অন্তত ৩৫ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। একজন দশ বছর ধরে সভাপতি পদে ছিলেন।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের সাবেক একাধিক কমিটির কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে ভর্তি বাণিজ্য ও সরকারের বিধিবিধান লঙ্ঘন করে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে তা প্রমাণিতও হয়েছে। আবার এই দুই প্রতিষ্ঠান ঘিরে জামাতপন্থি অভিভাবকের বাহারী নামের সমিতিও রয়েছে। সময় বুঝে এইসব সমিতির নাম ও ব্যানার বদল করে তারা। মূলত তারা অবৈধ ভর্তি করিয়ে ফি বছর কাড়ি কাড়ি টাকা কামান। গত ৫/৬ বছরে তাদের অবৈধ ভর্তিবাণিজ্য বন্ধ করে তা স্থানীয় এমপি ও তাদের সাকরেদরা নিয়ন্ত্রণ করছেন । এতে ক্ষুব্ধ হয়ে এই দুই স্কুলের বিরুদ্ধে নানা ধরণের অপপ্রচার করে চলছেন তথাকথিত অভিভাবক ফোরাম। আর এদেরকে সহায়তা করছেন সংবাদপত্রের কার্ড ও টেলিভিশনের বুম হাতে থাকা শিবিরকর্মীরা।
এই দুই প্রতিষ্ঠানই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির বিরুদ্ধে এভাবে অহরহ অভিযোগ উঠছে।
প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাটের মজা পেয়ে অনেককেই কমিটিতে জায়গা করার ক্ষেত্রে রীতিমতো মারামারি-হানাহানি আর রক্তারক্তি করতেও দেখা যাচ্ছে।
রাজধানীর মতিঝিল মডেল স্কুল ও কলেজের ক্ষেত্রেও সিনিয়র কয়েক শিক্ষকের বিরুদ্ধে আছে অভিযোগের তীর।
পুরান ঢাকার শেখ বোরহান উদ্দিন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের জমি কেনার নামে জাল দলিল, বিভিন্ন কেনাকাটায় ভুয়া ভাউচার, জালিয়াতি করে শিক্ষক নিয়োগ, শিবিরকর্মীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ, মিটিংয়ের সম্মানীসহ নানা নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক সংস্থা তদন্ত করছে। ওই ঘটনায়ও অভ্যন্তরীণ ৪-৫ জনের একটি চক্র কমিটির চেয়ারম্যান এবং দুর্নীতিবাজ সদস্যের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন।
আবার কোথাও কমিটির সঙ্গে দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষকদের লুটপাটে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ আছে। রাজধানীর দনিয়া কলেজে বিভিন্ন সময়ে ৪১ কোটি ৪০ লাখ ৯৪ হাজার টাকার অনিয়ম পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংস্থা পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)।
ডিআইএর আরেক তদন্তে উঠে এসেছে যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ, রাজশাহী মসজিদ মিশন স্কুলে দুর্নীতি চিত্র। তদন্ত চলছে উইলস লিটল স্কুল ও কলেজের অনিয়মের অভিযোগ। মসজিদ মিশন স্কুলে গিয়ে টাকার বিনিময়ে মনগড়া প্রতিবেদন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় কমিটির ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ওই ঘটনায় অধ্যক্ষের সরাসরি পক্ষ নিয়েছিলেন জিবির সহসভাপতি রুহুল আমিন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিচালনা কমিটির দৌরাত্ম্যের কাছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও পর্যন্ত রীতিমতো অসহায়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দিয়েও তা বাস্তবায়ন করাতে পারছে না।
এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে দুই ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা প্রশাসনের কর্তারা।
বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি ও প্রবীণ অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান বলেন, সব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। যেগুলোর আর্থিক অবস্থা ভালো এবং সুনাম রয়েছে সেগুলোর ওপর টাগের্ট থাকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের। আর সুনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে সারাবছরই লেগে থাকে নানা ধরনের সমস্যা। নির্বাচিত হয়েও যারা কমিটিতে আসেন তাদের অনেকের পক্ষেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানোন্নয়নে দেয়ার মতো কোনো যোগ্যতা থাকে না। তাই সুনামধন্য কিন্তু নানা ধরনের ভেজালে নিমজ্জিত প্রতিষ্ঠানের বিশেষ ধরনের পরিচালনা পর্ষদ বা কমিটি চালু করা যেতে পারে যা বছরের পর বছর ধরে চলবে। এর জন্য দরকার হবে বিদ্যমান বিধান চালু করা। বিশেষ কমিটিতে সরকারের সংশ্লিষ্টরা থাকবেন। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যদি এমন বিশেষ কমিটি চালু হয় তবে অন্যরা ভয়ে থাকবেন। তাদের মধ্যে ভয় ঢুকবে বেশি বাড়াবাড়ি করলে কমিটি সরকারের হাতে চলে যাবে। এতে একটা ভারসাম্য তৈরি হবে।
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল পরিচালনা কমিটির কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সরব। তিনি প্রায়ই বলে থাকেন রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে ব্যবস্থাপনা কমিটির অশিক্ষিতরা শিক্ষকদের ওপর বেশি কর্তৃত্ব ফলান। শিক্ষকদের সম্মান দেয়ার মতো শিক্ষিত লোক ব্যবস্থাপনা কমিটিতে নিযুক্ত করার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনার পক্ষে তিনি।
এদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতিসহ অন্যান্য পদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়টি সারাদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যদি কমিটির সভাপতি হতে হলে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক তাহলে হাইস্কুলে-কলেজে তো মাস্টার্স ডিগ্রি করা উচিত। সারাদেশে এমন দাবি প্রবল। দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্যই কমিটির সভাপতিসহ অন্যান্য পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করার পক্ষে।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রবিধানমালা করা হয়। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে সর্বশেষ এটি সংশোধন করা হয়। ফের সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশে বর্তমানে এটি আরেক দফা সংশোধনের কাজ চলছে বলে জানা যায়। বিদ্যমান বিধিতে বেতন-ভাতা প্রদান, শিক্ষক নিয়োগসহ এসএমসি ও জিবির ১৬টি দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতা আছে। তবে সরকার যেহেতু প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, নিয়োগ, বেতন প্রদানসহ সবই দিচ্ছে, তাই এখন কমিটির সেই ভূমিকা নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।