করোনাকালে শিক্ষার্থীদের করণীয় - দৈনিকশিক্ষা

করোনাকালে শিক্ষার্থীদের করণীয়

অধ্যক্ষ এস এম খায়রুল বাসার |

করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবে বিশ্ব আজ স্থবির। অন্যান্য বিষয়ের সাথে স্থবির শিক্ষাব্যবস্থাও। ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য অনুয়ায়ী করোনার প্রকোপে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীর ৯১ দশমিক ৩০ শতাংশেরই পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত।

করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও সংকটাপন্ন। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় মিলে  আমাদের প্রায় পৌনে পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী। বোঝাই যায়, আমাদের দেশে আগামী ৬ পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধই থাকছে। এটা বলা যায়, প্রতিষেধক বা চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবনে যত দেরি হবে, মহামারির স্থায়িত্বকাল তত দীর্ঘায়িত হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান  বন্ধের মেয়াদও ততটা বাড়বে।

প্রশ্ন হলো, এই দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের শিক্ষার্থীরা কি অলস সময় কাটাবে? এক কথায় উত্তর হল, না। দু’দিন আগে হোক আর  দু’দিন পরে হোক করোনার তাণ্ডব থেমে যাবে। জীবন তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পাবে। তখনকার হিসাব এখন থেকেই করতে হবে আমাদের। শিক্ষার্থীদের সর্বপ্রথম কাজ হবে, সংক্রামক ভাইরাস করোনা থেকে রক্ষা পেতে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রেখে বাসা/বাড়িতেই অবস্থান করা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এমন খাদ্য গ্রহণ করা। নিয়মিত শরীর চর্চা করা, মাদক থেকে দূরে থাকা। করোনা থেকে নিজে সচেতন থাকা, পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধবদের মোবাইলে বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে সচেতন করা।

এই দুঃসময়ে শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় কাজ হলো পিতামাতাকে বাড়ির কাজে সহযোগিতা করতে হবে। মাথায় নিতে হবে, অন্তরে ধারণ করতে হবে যে, বছরজুড়ে পিতা-মাতা আমাদের জন্য কতই না কষ্ট করেন! তাই এখনই সুযোগ, এখন থেকেই পিতামাতাকে কাজে সহযোগিতা করে, তাদের কষ্টের উপশম করতে হবে, তাদের অন্তত একটু শান্তিতে থাকতে দিতে হবে। বিশেষ করে যারা গ্রামে থাকো, তারা এই সময়ে বেশি বেশি করে কৃষিকাজে সাহায্য করবে। কেননা, ফসল কর্তন ও সংরক্ষণ এবং কৃষি উৎপাদন অব্যাহত না রাখতে পারলে করোনাকালে অথবা করোনা পরকর্তীকালে আরও ভয়াবহ বিপদ দেখা দিতে পারে।

ইতোমধ্যে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ বিশ্বে তিন কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারে। এদিকে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও মজুদ ভালো অবস্থায় থাকলেও, চল্লিশ লাখ হতদরিদ্র মানুষ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম। এই সময়ে কৃষকদের বোরো ধান উঠানোর সময়। বাংলাদেশে সারা বছরে যে পরিমাণ ধান উৎপাদিত হয় তার একটি বিরাট অংশ অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক আসে বোরো মৌসুম থেকে। কিন্তু গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কৃষি শ্রমিকের সংকটে দেখা দিয়েছে। এইজন্য ধান কাটা, ধান পরিবহন, মাড়াই, শুকানো, ঘরে তোলার কাজে অবশ্যই সাহায্য করতে হবে শিক্ষার্থীদের। পাশাপাশি উৎপাদন অব্যাহত রাখতেও সাহায্য করতে হবে।

‘একটু জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। ঘরের কোনায় হলেও কিছু ফসল ফলান, ফলমূল আবাদ করুন। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে অল্প একটু জমিও যেন পড়ে না থাকে’- মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বানে আমাদের সাড়া দিতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে, পারলে আগের চেয়ে বেশি উৎপাদন করতে সকলকে উৎসাহ দিতে হবে। পিতার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে ফসল ঘরে তুলতে, খাদ্য উৎপাদন কাজে নিজেদেরকে বেশি করে সম্পৃক্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিজেদের ঘরে উদ্বৃত্ত খাদ্য থাকলেই কেবল অন্যকে সাহায্য করতে পারা যাবে। আর বিপদকালে বিপদাপন্ন মানুষের পাশে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েই আমাদের প্রমাণ করতে হবে, ‘মানুষ মানুষের জন্য’। 

করোনা পরিস্থিতি, করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, শিক্ষার্থীরাই জাতির ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতে তাদের মধ্য থেকেই আমরা পাব একেকজন বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ, দক্ষ প্রশাসক, উদ্যোক্তা, খেলোয়াড়, সমাজকর্মী, শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক ইত্যাদি ইত্যাদি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বকল্যাণে কাজ করবে তারাই। এইজন্য শিক্ষর্থীদের আলোকিত মানুষরূপে গড়ে উঠতে হবে। আলোকিত মানুষ হতে হলে এই দুঃসময়েও দৃঢ় মনোবল নিয়ে অধ্যবসায়ী ও সময়ানুবর্তী হতে হবে। চলমান দীর্ঘ ছুটিকালীন পড়ালেখাকেও ছুটি দিয়ে দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে একজন মনীষীর উদাহরণ তোমাদের না দিলেই নয়।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের অসংখ্য শাখায় সুগভীর পাণ্ডিত্য অর্জনকারী বিখ্যাত জ্ঞানতাপস আল-বেরুনি মৃত্যশয্যায় শায়িত। এই সময় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এক বিজ্ঞানী বন্ধু এলেন। আল-বেরুনি সে অবস্থায় তার বন্ধুকে গণিত সম্পর্কে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে বসলেন। মৃত্যুর দুয়ারে দাড়িয়েও এমন জ্ঞান অন্বেষণ! আল-বেরুনির বন্ধুটি খুবই আশ্চর্য হলেন। বন্ধুটি বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন, তুমি কি না এই অবস্থায়ও নতুন কিছু জানতে প্রশ্ন করছো! আল-বেরুনি বললেন, আমার জন্য কি এটাই বাঞ্ছনীয় নয় যে, একটা প্রশ্নের সমাধান জেনে নিয়েই মৃত্যু সুধা পান করব? এটা কি না জেনে ইহধাম ত্যাগ করার চাইতে উত্তম নয়? বন্ধুকে বিদায় দেয়ার অব্যবহিত পরেই আল-বেরুনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একবার ভাব, জ্ঞানীরা কেন জ্ঞানী হয়েছেন। সুতরাং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পড়ালোখা করে যাওয়াই জ্ঞানীর কাজ।

তাই বর্তমান সময়কে কোনোভাবেই হেলায় হারানো যাবে না, কাজে লাগাতে হবে। ছুটিকালীন নতুন করে দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করতে হবে। যেখানে খাওয়া-দাওয়া, পড়ালেখা, প্রার্থনা, পিতা-মাতাকে সাহায্য করা, পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধবদের সচেতন করা, শরীরচর্চা, বিনোদন, খেলাধুলা ইত্যাদি দৈনন্দিন কাজের সময় বিভাজন থাকতে হবে।

ঘরে বসে নিজেদের পাঠ্যবই পড়া চালিয়ে যেতে হবে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্লাস দেখতে পার। ক্লাসুগলো এটুআই পরিচালিত কিশোর বাতায়নেও থাকছে। ইউটিউবেও শ্রেণি অনুযায়ি বিষয়ভিত্তিক অনেক লেকচার আছে। এছাড়া টেন মিনিট স্কুল, ব্র্যাক ই-শিক্ষা কর্মসূচি, খান একাডেমিসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিষয়ভিত্তিক কিছু কিছু লেকচার আছে। শিক্ষা বিষয়ক যাবতীয় সিদ্ধান্ত সবার আগে পাওয়া যায় দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে লেখাপড়ার পাতা আছে। সেগুলোর সহায়তা নেয়া যেতে পারে। বুঝতে সমস্যা হলে বিষয় শিক্ষকের সাথে, সহপাঠীদের সাথে মোবাইল বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে বুঝে নিতে হবে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি যার যার ধর্মীয় গ্রন্থ, বিভিন্ন শিক্ষামূলক গল্প, মনীষীদের জীবনী, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়তে পারো। প্রিন্ট কপি না পেলে নিয়মিত অনলাইন পেপার-পত্রিকা পড়তে পারো। তবে মূল ধারার পেপার-পত্রিকা পড়তে হবে।

প্রযুক্তি আসক্তি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হবে। বর্তমানে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোন আমাদের পরিবারেই একটি অংশ বলে বিবেচিত হচ্ছে। করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে এসব প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার করে গেম খেলা, ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার ইত্যাদির ব্যবহার বেড়ে গেছে। কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, এসবের প্রতি ভালো লাগা, উপভোগ করা থেকে যেন কোনোরকমেই এগুলোতে আমরা যেন আসক্ত না হয়ে পড়ি। 

বিআরবি হাসপাতালের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের পরামর্শক ডা. দেওয়ান আবদুল রহিম বলেছেন, ইদানিং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানসিক ব্যাধির ম্যানুয়ালের মধ্যে গেমিং ডিসঅর্ডার নামে একটি রোগের কথা বলেছে। অদূর ভবিষ্যতে সেলফি এডিকশন এসে যাবে। তিনি আরও বলেছেন, এসবের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়লে, ঘুমের সমস্যা হবে। অনিদ্রায় ভুগতে হবে। ফলে মস্তিষ্কের অপরিপক্বতা তৈরি হতে পারে। শরীরের মধ্যেও নানা ঘাটতি দেখা দিতে পারে। পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার আসতে পারে। উদ্বেগ হতে পারে। অর্থাৎ নানাবিধ মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসুখও হয়ে যেতে পারে। তাহলে একাডেমিক পারফরম্যান্স, লেখাপড়ার মান কমে যবে তাই এসব প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার করে আমাদেরকে জ্ঞানের সন্ধান করতে হবে। তবে সুস্থ ধারার গান শোনা, মুভি, খেলাধুলা দেখা যেতে পারে। শরীরচর্চা বিষয়ক কনটেন্ট দেখা যেতে পারে। ছুটিকালীন বাড়ির কাজে পিতামাতাকে সহযোগিতা না করে মাত্রাতিরিক্ত গেম খেলে, ফেসবুক, ইউটিউব, টিভি দেখে অযথা পিতা-মাতার বিরক্তির কারণ হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। 

কোনোরূপ দুশ্চিন্তা না করে এই দুঃসময়ে মানবসেবার মহান ব্রত নিয়ে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য হয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা যেতে পারে। সর্বশেষ, নিজ নিজ ধর্মমতে সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। পাশাপাশি করোনা থেকে মুক্তি পেতে নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, পরিবার-পরিজন, শিক্ষক, প্রতিবেশী, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধবসহ দেশ-জাতির জন্য দোয়া করতে হবে। আশা করি, অচিরেই তোমাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবে রূপ নেবে, তোমাদের নিয়ে নতুন করে সাজবে পৃথিবী।

লেখক : এস এম খায়রুল বাসার, অধ্যক্ষ, পল্লীমঙ্গল আদর্শ মহাবিদ্যালয়, ইছামতি, অভয়নগর, যশোর।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]

কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030779838562012