করোনা থেকে যেটুকু শিখেছি - দৈনিকশিক্ষা

করোনা থেকে যেটুকু শিখেছি

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

পৃথিবীর অনেক দেশে ইতোমধ্যে করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ শুরু হয়ে গেছে। শীত শুরু হতে না হতেই আমাদের দেশে করোনার দ্বিতীয় ধকল শুরু হবার আশংকা করছেন অনেকে। এর মধ্যে পুরো পৃথিবীতে শুধু করোনায় দশ লাখের উপরে মানুষের প্রাণ গিয়েছে। এখনো প্রতিদিন গোটা দুনিয়া জুড়ে লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। কখন, কোথায় গিয়ে তা শেষ হবে-কেউ জানে না। কেবল আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এখন আর আগের মতো করোনার ডর-ভয় নেই। করোনাকে মানিয়ে নেয়ার এক অদম্য প্রয়াস সর্বত্র মানুষের মাঝে পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে, প্রাকৃতিক নানা দূর্যোগের সাথে খাপ খেয়ে চলার প্রবণতা মানুষের একান্ত সহজাত একটি প্রবৃত্তি। 

মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই মানুষ প্রাকৃতিক দূর্যোগ তথা মহামারির সাথে খাপ খেয়ে চলছে। এভাবে মানুষের অদম্য মনোবলের কাছে প্রকৃতি হার মেনেছে কিংবা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। এরকম করে করে হাজার-কোটি বছর ধরে মানবজাতি দাপটের সাথে পৃথিবীতে টিকে আছে। হয়তো টিকে থাকবে আরও হাজার-কোটি বছর।

করোনা মহামারি আমাদের সে সব মেনে চলার তাগিদ দিয়েছে। বিজ্ঞান বহু আগে শিখিয়েছে, মানুষ দুষিত কার্বনডাই অক্সাইড ত্যাগ করে আর অক্সিজেন গ্রহণ করে। মানুষ শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করলে বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস কিছুটা হলেও এড়িয়ে চলতে সক্ষম হয়। করোনায় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার অনুশীলন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উপদ্রব থেকে আমাদের সামান্য হলেও রক্ষা করেছে।

আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, লকডাউন ইত্যাদি শব্দের সাথে এখন আমরা পরিচিত হয়েছি। পজিটিভে আতংকিত আর নিগেটিভে আনন্দিত হওয়া আমরা করোনাকালেই শিখেছি। এর আগে সর্বদা নিগেটিভকে নিগেটিভ আর পজিটিভকে পজিটিভ ভেবেছি। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনার বিষয়ে করোনা যে বার্তাটি দিয়েছে, সেটি করোনা চলে যাবার পর মেনে চলতে পারলে আমাদেরই লাভ হবে।

করোনাকে শুধু নেতিবাচক দৃষ্টিতে না দেখে ইতিবাচক দৃষ্টিতে এর বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। করোনাকালের প্রথমদিকে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় সঞ্চয়ের গুরুত্ব হাড়ে-হাড়ে বুঝতে পেরেছে। অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয়ের সংজ্ঞা যাই হোক না কেনো, ভবিষ্যতের যে কোনো বিপদ আপদে তা খুব বেশি কাজে আসে। অনেক মানুষ 'খাও, দাও, ফূর্তি করো' নীতিতে অতি বিশ্বাসী হয়ে ভবিষ্যতের কোনো চিন্তা করে না। এরা যে কোনো কারণে কর্মহীন হয়ে পড়লে তাদের দুর্দশার সীমা থাকে না। এ জাতীয় মানুষদের করোনা দূর্দিনের জন্য সঞ্চয়ের উত্তম শিক্ষা দিয়েছে। এটি আমলে নিতে পারলে করোনাত্তোর পৃথিবী আর্থিকভাবে আরও অনেক সমৃদ্ধ হবে।

মানুষ মানুষের জন্য। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। করোনায় এই চিরন্তন কথাগুলোর ব্যাপক চর্চা হয়েছে। বিশ্বময় মানবতার জয় হয়েছে। নিরন্ন মানুষের কাছে সামর্থ্যবানরা খাদ্য ও ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ছুটে গেছে। মানুষের জন্য মানুষ তার ভালবাসা উজাড় করে দেবার এক সুবর্ণ সুযোগ খুঁজে পেয়েছে। পাশাপাশি এক শ্রেণির মানুষের হাতে মানবতার বিপর্যয় নির্মমভাবে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। দেশ ও জাতির চরম ক্রান্তিকালে করোনা এসব অমানুষদের মুখোশ খুলে তাদের আসল রূপ আমাদের সামনে উন্মোচন করে দিয়েছে। করোনা না এলে শাহেদ-সাবরিনাদের কোনদিন চিনতে পারতাম না। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার বহুদেশে অবসর নেয়া ডাক্তার-নার্সেরা করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেবার জন্য করোনার মাঠে ছুটে এসেছেন আর আমাদের দেশে কর্মরত অনেক চিকিৎসক ও নার্স নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য রোগীদের ফেলে রেখে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। করোনায় মানবতা ও মনুষত্বের পরীক্ষায় কেউ উত্তীর্ণ এবং কেউ অনুত্তীর্ণ হয়েছে। মানুষের বিপদ আপদে কারো মানবতা জাগ্রত হয় আর মানবতার ধ্বজাদারীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়।

এতদিন কাছাকাছি বসে সামনা-সামনি আমরা সভা, সেমিনার করেছি। মিটিং করেছি। তাতে অর্থ ও সময় উভয়ের অপচয় হতো। এখন দিনে দিনে আমরা জুম মিটিংয়ে অভ্যস্ত হয়েছি। তাতে যথাসময়ে মিটিং যেমন শুরু করা যায়, তেমনি অর্থের অপচয় কম হয়। এমনি জুম অ্যাপসের মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনা করা যায়। প্রশিক্ষণ চালানো যায়।

করোনায় প্রকৃতির হাতে মানুষের অসহায়ত্বের বিষয়টি আবারও দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সভ্যতার সোপানে আরোহণ করে মানুষের প্রকৃতিকে বশে আনার অহমিকা করোনায় প্রমাণিত হয়েছে। প্রকৃতির গতি প্রকৃতি নিয়ে আগেভাগে মানুষের অবগত হবার সুযোগ একেবারে কম। তা না হলে করোনা আসার আগেই মানুষ করোনার ভ্যাকসিন আবিস্কার করে রেখে দিতে পারতো। ভবিষ্যৎ জানার ক্ষেত্রে মানুষ একান্তই অজ্ঞ। তবু, সম্ভাব্য দূর্যোগ ও তার প্রতিকার বিষয়ে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের আগে থেকেই চিন্তা করে সঠিক উপায় ঠিক করে রাখা উচিত। করোনায় এ বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।

গোটা পৃথিবীর শিক্ষা কার্যক্রম একসাথে এর আগে কোনদিন প্যারালাইজড হয়ে পড়েছিলো কিনা জানা নেই। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে ইতোপূর্বে আমরা এতটুকু পরিচিত না হলেও করোনায় আমরা এটি অনেকটা আয়ত্ব করে ফেলেছি। এখন প্রান্তিক ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষকেরা পর্যন্ত অনলাইন পাঠদানে পারদর্শী হয়ে উঠছেন। এক সময় কেবল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সীমিত ক্ষেত্রে অনলাইন পাঠদান চালু ছিল। করোনায় সেটি প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত চলে এসেছে। সুশিক্ষিত মানেই স্বশিক্ষিত। নিজের চেষ্ঠায় শিক্ষক ক্লাস রেকর্ডিং, এডিটিং সবই করছেন। ক্লাস আপলোড দিচ্ছেন। কোনো কোনো শিক্ষক ইউটিউব চ্যানেল খুলে তার অসংখ্য ক্লাস তাতে জমা করে রাখছেন। শিক্ষার্থীরা ইচ্ছে করলে চ্যানেল সাবস্ক্রাইভ করে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের ক্লাস সহজে দেখতে পারছে। এজন্য যে যে ডিভাইসের প্রয়োজন সেগুলো নিজের সামান্য বেতনের টাকা থেকে কিনতে পিছপা হচ্ছেন না। নিজেদের মধ্যে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা শেয়ার করে তারা দিনে দিনে আরও প্রশিক্ষিত হয়ে উঠছেন। 
আমাদের শিক্ষার জন্য এটি একটি ইতিবাচক দিক। করোনা একদিন চলে গেলেও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম আরও জনপ্রিয় উঠবে বলে মনে হয়। গতানুগতিক শিক্ষা পদ্ধতির আমুল পরিবর্তন বা সংস্কার যখন খুব প্রয়োজন, ঠিক সে সময়ে করোনার কারণে আমরা অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের দিকে অগ্রসর হয়েছি। এ কার্যক্রমটি সুস্থ্য ও স্বাভাবিক সময়ে অব্যাহত রাখতে পারলে শিক্ষার আমুল উন্নতি হবে। প্রয়োজন আবিস্কারের জননী-করোনাকালে অনলাইন পাঠদানে অভ্যস্ত হয়ে শিক্ষক সমাজ সে কথাটি প্রমাণ করে ছেড়েছেন।

গতসপ্তাহে আমাদের দেশে এবারের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা বাতিল করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের জেএসসি-সমমান ও এসএসসি-সমমান পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে পাস দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশই অটোপাসের দিকে অগ্রসর হতে বাধ্য হয়েছে। আমাদেরও এর কোনো বিকল্প ছিল না। এর অন্য কোনো ভালো বিকল্প আগে থেকে ঠিক করে রাখা থাকলে আমরা সেদিকেই যেতে পারতাম। পরীক্ষা নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি চালু থাকায় মূল্যায়নের জন্য আমরা কেবল পরীক্ষার উপর নির্ভর করে থাকি। কিছু শিখুক বা নাই শিখুক সন্তান পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়া বা পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করা আমাদের কাছে যেন সবকিছু। তাই এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় যেমন মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি কিসের ভিত্তিতে ফল দেয়া হবে সেটি একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ আগে থেকে একটি বিকল্প পন্থা বের করে রাখলে আজ এ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ সৃষ্টি হতো না। সবক্ষেত্রে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (CA), বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়ন (SBA), ক্লাস টেস্ট, পাক্ষিক ও মাসিক মূল্যায়ন, কার্যকর ব্যবহারিক পরীক্ষা এবং সর্বোপরি শিক্ষায় কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকলে আজ আমাদের এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। করোনা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার গলদগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটি ঢেলে সাজাতে পারলে দেশ ও জাতির অনেক লাভ হবে।

আমাদের দেশে করোনায় সব শ্রেণি, পেশার মানুষের দূর্ভোগ বাড়লেও বেসরকারি শিক্ষকদের আরও বেশি দুর্দশায় পড়তে হয়েছে। যাদের এমপিও নেই, তাদের অনেককে শাক সব্জি বিক্রি করে কিংবা ভ্যান গাড়ি চালিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে। অনাহারে ও অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। যাদের এমপিও আছে, তারা ছয় মাস থেকে প্রতিষ্ঠানের বেতনের অংশ পাচ্ছেন না। শুধু বেতনের সরকারি অংশের টাকা দিয়ে সংসার নির্বাহ করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা নানাভাবে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন। স্কুল-কলেজে সন্তানের কয়েক মাসের বকেয়া বেতন জমে আছে। সে দুশ্চিন্তায় তাদের মাথা খারাপ হয়ে যাবার অবস্থা। শিক্ষা সরকারিকরণ হয়ে থাকলে করোনার মতো দুঃসময়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কোনো দুশ্চিন্তা থাকে না। করোনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আসুন আমরা করোনাত্তোর একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে সচেষ্ট হই। করোনাকে কেবল অভিশাপ হিসেবে না দেখে এর ইতিবাচক দিক নিয়ে আরো গবেষণা করি। ভবিষ্যতে এরকম মহামারিতে যেন বিকল্প পথে জীবনযাত্রা চালিয়ে নিতে পারি।

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট।

শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0072309970855713