কামিনী রায়ের জন্ম-ঠিকানা ‘ঝালকাঠি’ - দৈনিকশিক্ষা

কামিনী রায়ের জন্ম-ঠিকানা ‘ঝালকাঠি’

পলাশ রায় |

‘করিতে পারি না কাজ/সদা ভয় সদা লাজ/সংশয়ে সঙ্কল্প সদা টলে/পাছে লোকে কিছু বলে’

বাঙালি চরিত্রের এই সাধারণ বৈশিষ্ট্য যার কবিতায় ফুটে উঠেছিল, তিনি কবি কামিনী রায়। ঊনিশ-বিশ শতকের নারী লেখক ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক। অন্তত এই কবিতার জন্য হলেও কামিনী রায় বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ যুগ ধরে, যতদিন টিকে থাকবে বাঙালি বা বাঙলা সাহিত্য।

তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম নারী স্নাতক ডিগ্রিধারী ব্যক্তিত্ব কবি কামিনী রায়ের জন্ম কোথায়? এমন প্রশ্ন করা হলে দেশের সাধারণভাবে শিক্ষিত যে কোনো মানুষই উত্তর দেবেন, বরিশালের বাসন্ডা গ্রামে।

বর্তমান বরিশাল জেলার একটি উপজেলার নাম বাকেরগঞ্জ। কিন্তু বর্তমান বাকেরগঞ্জ উপজেলাটির কোথাও বাসন্ডা নামে কোনো গ্রাম বা স্থান খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে কি আমাদের জানা এ তথ্য ভুল? প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। বিষয়টি যে একেবারেই ভুল, তাও আবার নয়। তবে প্রমাণিত সত্যের পেছনেও অজানা রহস্য লুকিয়ে থাকে কখনো কখনো। আজ যা সত্যি, কাল তা নতুন করে জানতে হতে পারে।

মূল কথা এটা নয়। বাকেরগঞ্জ বা বাসন্ডা দুটোই সে সময়ের জন্য সঠিক ছিল। তবে আজ তার পরিবর্তন হয়েছে। বিষয়টি এমন, ব্রিটিশ আমলে বাকেরগঞ্জ ছিল জেলা, বরিশাল নয়। ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে বাকেরগঞ্জ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে জেলা সদর বাকেরগঞ্জ থেকে বরিশালে স্থানান্তর করা হয়। তৎকালীন সময়ের প্রভাবশালী জমিদার আগা বাকের খানের নামানুসারে এ জেলার নামকরণ হয় বাকেরগঞ্জ। তখন থেকে কাগজপত্রে ঠিকানা উল্লেখ করতে হলে ‘বাকেরগঞ্জের অমুক’ স্থান নামেই বর্তমান বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা দেশে পরিচিত হতো। সেসময় জেলার আয়তন ছিল ৪,০৬৬ বর্গমাইল (১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দ অনুসারে), যা বর্তমান মাদারীপুর, বরিশাল, ঝালকাঠী, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলা জুড়ে বিস্তৃত ছিল।

সেদিনের বাকেরগঞ্জ জেলাটি আজ বরিশালের একটি উপজেলা। বাকেরগঞ্জ জেলা নামটি ১৭৯৭ থেকে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বরিশাল বিভাগ সৃষ্টির ফলে বাকেরগঞ্জ নামটি জেলা থেকে বাদ দেয়া হয়। জেলা সদর বরিশালের নামে বিভাগের নামকরণ করা হয়। তবে তখন ব্রিটিশ যোগাযোগ আর শিল্পসংস্কৃতির উন্নয়নে বরিশাল সদর গৌরবেই পরিচিত ছিল। কেবল কাগজপত্রে লেখা হতো বাকেরগঞ্জ জেলার অমুক স্থান।

এই বাড়িতেই জম্মগ্রহণ করেন কবি কামিনী রায়

এখন আসি কোথায় বাসন্ডা। বাসন্ডা গ্রামটি বর্তমান ঝালকাঠি শহরতলীতে অবস্থিত। বাসন্ডা নদীর পাড়ে বর্তমান নেছারাবাদ মাদরাসার পাশেই এ গ্রামটি। গ্রামের নামেই নাম ইউনিয়নেরও।

১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ অক্টোবর বাসন্ডার তৎকালীন জমিদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন কবি কমিনী সেন (বিয়ের পরে কমিনী রায়)। তার বাবা চণ্ডীচরণ সেন বাসন্ডার ডাকসাইটে জমিদার ছিলেন। পরবর্তীতে যিনি অতিরিক্ত মুন্সেফ নিযুক্ত হন। সাবজজ হিসেবেও সুনাম অর্জন করেন। তিনি লেখকও ছিলেন। তারই দুই মেয়ে কামিনী সেন (বিয়ের পরে কামিনী রায়) ও যামিনী সেন ঝালকাঠির বাসন্ডার ওই জমিদার বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। কবির স্বামী সিভিলিয়ান কেদারনাথ ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে অপঘাতে মারা যান। কবি তারপর আবারও ফিরে আসেন ঝালকাঠির বাসন্ডায় পৈত্রিক ভিটায়। তবে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষ ভাগের পরে সপরিবার চলে যান ভারতে।

তারপর কবির সে জন্মভিটা জমিদার বাড়িটি স্থানীয় একটি দখলদারচক্র দখল করে নেয়। আজও বংশানুক্রমে সে দখলদারদের কবলেই আছে ওই বাড়িটি। কবিদের সেন মঞ্জিল, পারিবারিক শ্মশানে কবিপুত্র অশোকের সমাধি, বাড়ির দরজার ওপারে বাসন্ডা খালে বাঁধানো ঘাট, সব ঐতিহ্যই একটু একটু করে বিনষ্ট করেছে ওই দখলদাররা। ঝালকাঠি ও বরিশালের সাংস্কৃতিক কর্মীরা বারবার চেষ্টা করেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় কবির স্মৃতিরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে বারবার।

ব্রিটিশ আমলের সেদিনের বাকেরগঞ্জের বাসন্ডাই আজকের ঝালকাঠি শহরতলীর বাসন্ডা। ব্রিটিশের পর পাকিস্তান আর তারপর বাংলাদেশ। মহকুমা থেকে ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি ঝালকাঠি পূর্ণাঙ্গ জেলা হয়। বাকলা বা পূর্বের ঐতিহাসিকদের লেখা পুস্তক হয়তো সংশোধন করার নয়,  কিন্তু দেশে বর্তমান সময়ে ছাপানো বই-পুস্তক তো আর তাম্রলিপি নয়। সেটা পরিমার্জনযোগ্য। কিন্তু এত বছরেও তা সংশোধন হয়নি। এখনও বই-পুস্তকে লেখা হয় কবি কামিনী রায়ের জন্ম বরিশালের বাকেরগঞ্জের বাসন্ডা গ্রামে। কিন্তু বাকেরগঞ্জ উপজেলায় গিয়ে কামিনী রায়ের বসত ভিটা খুঁজতে গেলে কেউ বাসন্ডা নামের গ্রামেরই অস্তিত্ব খুঁজে পাবেন না। সেখানকার বাসিন্দারা এ উপজেলায় এমন নামের একটা গ্রাম ছিল, তাও বলতে পারবেন না।

বই-পুস্তকে কবি কামিনী রায়ের জন্মস্থানের ঠিকানাটা এখনও যদি সংশোধন না করা হয়, তবে প্রজন্ম এ কবির জন্ম-ঠিকানা সম্পর্কে ভুল তথ্য জানবে। কবির জন্মভিটা বেদখল হওয়ার মত তার জন্ম-ঠিকানাটাও বিস্মৃতই থেকে যাবে প্রজন্মান্তরে, যার দায়ভার সরকারকেই বহন করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক

শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030889511108398