কারও আছে ক্ষমতা কারও আছে শক্তি - দৈনিকশিক্ষা

কারও আছে ক্ষমতা কারও আছে শক্তি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ক্ষমতা ও শক্তিতে মিল আছে অবশ্যই। তবু দুটি শব্দ এক নয়। ক্ষমতা শক্তি দেখানোর ক্ষমতা রাখে, শক্তিও পারে পরিণত হতে ক্ষমতায়; তবু ক্ষমতার সঙ্গে শক্তির একটা ব্যবধান আছে। আমাদের দেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টি নানাভাবে আলোচনায় এসেছে। গৃহস্থ বাড়ির পাহারাদার কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করে সেই লোকটিকে দেখে যে এসেছিল চুরি করতে, ভয় পেয়ে লোকটি পালায়। লোকটির শক্তি বেশি কুকুরটির চেয়ে; কিন্তু তার এমন ক্ষমতা নেই যে কুকুরটির মুখোমুখি হয়। পাহারাদার কুকুরটির ক্ষমতা আছে, যেটা সে তার মালিকের কাছ থেকে পেয়েছে। এই ক্ষমতা নৈতিক। শক্তির চেয়ে সে বড়। নৈতিক শক্তি খুবই জরুরি; কিন্তু অনেক সময় তাতে কুলোয় না। ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে নৈতিক শক্তির জোরে বাধা দিলে অনেক সময় যে বিপদ হয়, ওটা দেখা গেছে। অস্ত্রের কারণে ক্ষমতাবান ছিনতাইকারীরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়ে। চোর-ডাকাত কেন, ভালো মানুষও পদস্থ কুকুরটিকে সালাম জানায়, লোকটি যে আস্ত একটি কুকুর, সেটা জেনেও। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের বদনাম আছে সত্য; কিন্তু ঘটনা সব দেশেই সত্য। ক্ষমতা বড়ই দর্পিত, সর্বদাই সে ঘেউ ঘেউ করে, এমনকি যখন সে অত্যন্ত নীরব তখনও। ওই তার স্বভাব। আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে যদি রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা আসে, তাহলেও মিলবে এর সত্যতা। সোমবার (২২ জুলাই) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ কথা জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

বাংলাদেশে শক্তি আছে। গ্যাস, তেল, কয়লা রয়েছে- মাটির নিচে। এই সম্পদ নিয়েও নানারকম রাজনীতি দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়েছে স্বাধীন দেশে। পানিতে মাছ আছে, সমুদ্রে সামুদ্রিক সম্পদ। শক্তি আছে ভূমির। ভূমি অত্যন্ত উর্বর। বিপুল জনসমষ্টিকে সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। মানুষ খুবই পরিশ্রমী, এ দেশে। শক্তি আছে; কিন্তু ক্ষমতা নেই। সম্ভাবনা আটকা পড়ে রয়েছে ক্ষমতাবানদের অবরোধে। আমরা শাসিত হয়েছি সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা। সাম্রাজ্যবাদের রকমফের ঘটেছে, উপনিবেশবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ ইত্যাদির রূপ নিয়েছে যে; তার সর্বশেষ চেহারা-বদলটা হচ্ছে মুক্তবাজারের রূপ পরিগ্রহ করা। মুক্তবাজার খুবই ক্ষমতাবান, তার দাপটে আমাদের নিজস্ব ও স্থানীয় উৎপাদিকা শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। মার খাচ্ছে। সমস্যা আছে সংখ্যাগুরুর সঙ্গে সংখ্যালঘুর সম্পর্কের। গভীর ও জটিল সমস্যা। এর একটা রূপ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর ক্ষমতায়নের সমস্যা যে সহজে সমাধান করা যাবে, তা নয়। যায়নি। আর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে যে সংকট সে তো বেশ পুরনো বিষয়। অতীতে একে কেন্দ্র করে নানারকম কাণ্ড ঘটেছে। সাম্প্রদায়িকতা আসলে ক্ষমতার লড়াই। পরাধীন দেশে তো বটেই, স্বাধীন বাংলাদেশেও এর নজির আছে। মূল প্রশ্নটা ক্ষমতার ভাগাভাগির। রাজনীতিতে যার প্রকাশটা ভিন্ন প্রকারের। কিন্তু আরও একটি সাধারণ ব্যাপকতর রূপ আছে সংখ্যাগুরুর সঙ্গে সংখ্যালঘুর সম্পর্কের। সেটা ওই ক্ষমতার ব্যাপারেই। ক্ষমতা রয়েছে অল্প কিছু সংখ্যকের হাতে। সংখ্যালঘু নয় কেবল, অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক মানুষ এরা। ক্ষমতাবান এই সংখ্যালঘু ক্ষমতাহীন সংখ্যাগুরুর ওপর নিপীড়ন চালায়, তাদের ক্ষমতা কেড়ে নেয়, তাদের শক্তিকে বিকশিত হতে দেয় না। ফলে ক্ষতি হয় সমগ্র দেশের। দেশ শক্তিহীন অবস্থায় রয়ে যায়, শক্তি আছে অথচ নেই, এই হয় তার দশা। যে দশায় আমরা রয়েছি দীর্ঘকাল ধরে। ক্ষমতাবান কিংবা বলবান যা-ই বলি না কেন, তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সব পর্যায়েই দম্ভ প্রকাশ করে এবং সংখ্যাগুরুকে অবদমিত করে রাখে।

বড় রাজনৈতিক দলগুলো নানা নাম নিয়ে লড়াই করে। লড়াইটা ক্ষমতার ভাগাভাগিরই, অন্য কিছুর নয়। জনগণের জাতীয়তাবাদ, সমগ্র অর্থাৎ জনগণকে একটি জাতিতে পরিণত করা এবং তাদের ক্ষমতায়ন ঘটানোর জন্য বড় দলগুলো বড় হয়নি, জনগণকে তারা ব্যবহার করেছে নিজেদের প্রয়োজনে এবং লড়াই করেছে নিজেদের মধ্যে, সে লড়াইকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। কিন্তু জনগণ যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে গেছে। ক্ষমতা পায়নি। পানির গতি নিচের দিকে, ক্ষমতার গতি তেমন নয়। তার যাত্রা ঊর্ধ্বমুখী। নিচের স্তরগুলোকে সে ব্যবহার করে। তাদের কাঁধে পা রেখে ওপরে ওঠে। অনেকে আছেন যারা মনে করেন, মানুষের সভ্যতার ইতিহাস ক্ষমতালাভের চেষ্টারই ইতিহাস। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলও সেই রকমের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। দেখিয়েছেন এক পক্ষ ক্ষমতাবান হয়েছে, ক্ষমতার দর্পে স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে এবং অপর পক্ষ, বঞ্চিত যারা তারা এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। কেননা, এই বঞ্চিতরাও ক্ষমতা চায়, তাদের নিজের জন্য। এটা সত্য কিন্তু ক্ষমতার এই লড়াইটাকে আরও নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট করা দরকার। বোঝা দরকার যে, এটা হচ্ছে শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির দ্বন্দ্ব। ওই ক্ষমতা নিয়েই। রাসেল দেখিয়েছেন যে, ক্ষমতা ব্যবস্থার মধ্যে থাকে এবং এটাই সত্য। ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়, নইলে ক্ষমতা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই ব্যবস্থাটা মূলত সমাজব্যবস্থা। কিন্তু এর কাঠামোটা মূলত সামাজিক বা নৈতিক নয়, সেটা অর্থনৈতিক। রাষ্ট্র একে পাহারা দেয়। আর ক্ষমতাবানদের পক্ষের প্রচারকরা, ক্ষমতাবানদের কল্যাণের জন্য ভক্তি, শ্রদ্ধা, আনুগত্য ইত্যাদি আদায় করতে থাকেন। ক্ষমতাহীনরা ক্ষমতাবানদের মান্য করতে শেখে। ক্ষমতাবানদের শক্তি দেখে এবং ক্ষমতাবানদের প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ প্রচারণায় আকৃষ্ট হয়ে। চেষ্টা চলে সমাজব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখার। ব্যবস্থার জোরেই ক্ষমতাশীলরা ক্ষমতাবান হয়। প্রভুর পেছনে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের পেছনে নানাবিধ বাহিনী। ওই ব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে ক্ষমতার বিষয়টাকে ভাবা যাবে না। ভাবা উচিত নয়। 

একসময় রেনেসাঁস ঘটেছিল আমাদের এই দেশে, লোকপ্রসিদ্ধি সেই রকমেরই। সেই নবজাগরণের সীমাটা বোঝা যায় তার পরিণতিটা দেখলে। জনগণ জাগেনি। যে মধ্যবিত্তের চিত্তে কিছুটা চাঞ্চল্য জেগেছিল, সেও বিভ্রাট হয়েছে। একটি অংশ চলে গেছে ধর্মীয় পুনর্জাগরণের দিকে। ওইদিকে যারা গেছে তারা নিজেরা আচ্ছন্ন হয়েছে, জনগণের মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছে ওই আচ্ছন্নতাকে। ধর্মবাদিতা যে কতটা ক্ষতিকর হয়েছে, তার লক্ষণ ও প্রমাণ আমরা আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে দেখতে পেয়েছি। দেখতে পেয়েছি সাংস্কৃতিকভাবেও। দাঙ্গা হয়েছে। ভঙ্গ হয়েছে দেশ। এই যে অনেক আয়োজন ও ধ্বনি সত্ত্বেও তথাকথিত নবজাগরণ প্রকৃত জাগরণ আনতে পারল না, তার মূল কারণ হচ্ছে অধীনতা। দেশ পরাধীন ছিল; ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল বিদেশিদের হাতে। অধীন অবস্থার যে রেনেসাঁস তার অন্তরে দেখি তিনটা অনুজ্ঞা বেশ শক্তিশালী ছিল। একটি হচ্ছে, অবনত অবস্থায়ও উন্নতি সম্ভব; দ্বিতীয়টি, আমরা পরাধীন জাতি এবং অনেককাল পরাধীন থাকব। তৃতীয়টি হচ্ছে আরও বিপজ্জনক। সেটি হচ্ছে এই বক্তব্য যে, আমরা সামাজিক বিপল্গবের অনুমোদক নই। এখানে আমরা অর্থ তারা যারা অবনত অবস্থাতেও উন্নতি করেছি, পরাধীনতাকে মেনে নিয়েছি, ধরেই নিয়েছি যে অনেক যুগ ধরে পরাধীন থাকব।

উন্নতির কথা যদি বলি তাহলে বলতে হবে মানুষ মাত্রেই উন্নতি চায়। পরিবর্তন চায় তার অবস্থার। কিন্তু পরাধীনতার যে পরিমণ্ডল, সেখানে উন্নতি লক্ষণটি কী? লক্ষণটি হচ্ছে ক্ষমতাবানদের মতো হওয়া। তাদের নকল করা। লংকায় গিয়ে 'মহাভারতে'র রামভক্ত হনুমান বলেছিল সীতাকে, বানর হলেও আমি মানুষের মতো কথা বলতে পারি, আমি সংস্কৃত জানি। হনুমানের প্রশংসা রাম তার আগেই করেছেন। ভ্রাতা লক্ষ্মণকে বলেছেন যে, হনুমান হলেও নিশ্চয়ই অত্যন্ত বিদ্বান; কেননা মুখের পেশিতে কোনো প্রকার বিকৃতি না ঘটিয়ে ইনি অবলীলায় সংস্কৃত বলছে। হনুমানের জন্য এর চেয়ে উচ্চ প্রশংসা কী হতে পারে? সে তো পৌঁছে গেছে রামের কাছাকাছি। অবনতের আত্মোন্নতিও এই রকমই। প্রভুর মতো হওয়া। অবনতের পক্ষে তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিকশিত করা খুবই কঠিন। 'আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি'- এই কথাটা সব দেশের এবং সব কালের ক্ষমতাবান মানুষদের। স্বাভাবিক বক্তব্য। কেননা, সামাজিক বিপ্লব মানেই হলো ক্ষমতা হারানো। এই ক্ষমতা রাজনীতি থেকে উৎসারিত। আমাদের রাজনীতির অর্জন যেমন কম নয়, তেমনি বিসর্জনের খতিয়ানও ছোট নয়।

শিক্ষিত মানুষ অনেক সময় জনগণের পক্ষে গেছে। লড়াই করেছে। প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু সেটা তারা শ্রেণি হিসেবে করেনি, করেছে শ্রেণিচ্যুত ব্যক্তি হিসেবে। শ্রেণিচ্যুতির এই কাজটা খুবই কঠিন। এটা আমাদের দেশে আমরা দেখেছি। শ্রেণিচ্যুত হয়ে তারা জনগণের পক্ষে গেছে তাদের সংখ্যা অনেক নয়, অল্প। যারা গেছে তারাও টিকে থাকেনি। ফিরে এসেছে, নিজের শ্রেণিতে। তাতে বদনাম হয়েছে সমাজ বদলের বিপল্গবী চেষ্টার। আমাদের অনেক রাজনৈতিক লক্ষ্য ভেস্তে গেছে। ক্ষমতাসীনদের শ্রেণি-স্বার্থ সর্বদাই বিপ্লববিরোধী। তারা বিপল্গবের ধ্বনি তোলে বিপল্গবকে প্রতিহত করার প্রভিপ্রায়েই, বিপ্লবের স্বার্থে নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতাতেও এমনটা ঘটেছে। চেষ্টা চলেছে ক্ষমতাসীনদের কাছে যাওয়ার, নকল সাহেব হওয়ার, ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট হলেও পাওয়ার। ক্ষমতার লোভে জ্বলজ্বল করেছে চোখে। ওই আলো জাগরণে সাহায্য করে না, বরঞ্চ উদ্রেক করে ভীতির।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক।

আপিলে যাবে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিকে বৃহস্পতিবারও ছুটি - dainik shiksha আপিলে যাবে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিকে বৃহস্পতিবারও ছুটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ মে’র পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ মে’র পরীক্ষা স্থগিত শিক্ষার্থীদের শাস্তি কোনো সমাধান নয় - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের শাস্তি কোনো সমাধান নয় হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় - dainik shiksha হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে সেশনজটের শঙ্কা বুয়েটে - dainik shiksha সেশনজটের শঙ্কা বুয়েটে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে মাধ্যমিক প্রজন্মের উপার্জন কমবে ৩১ বিলিয়ন পাউন্ড - dainik shiksha মাধ্যমিক প্রজন্মের উপার্জন কমবে ৩১ বিলিয়ন পাউন্ড please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040390491485596