রাজধানীর কুর্মিটোলা হাইস্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অননুমোদিত নিম্নমানের বই নির্বাচন, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস, টাকার বিনিময়ে শিক্ষকদের ক্লাস বণ্টন, অবৈধভাবে শিক্ষক নিয়োগ, অর্থ আত্মসাৎ, স্বজনপ্রীতি ও শিক্ষকদের মাঝে দলাদলি সৃষ্টিসহ নানাবিধ অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগে জানা যায়, সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ২০১৭ এবং ২০১৮ খিস্টাব্দে অনুদানের নামে বিপুল পরিমাণ টাকা প্রকাশনা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে গ্রহণ করে শিক্ষার্থীদের নিম্নমানের নোট-গাইড ও সহায়ক বই কিনতে বাধ্য করেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক। এমনকি নির্দিষ্ট প্রকাশনীর ডাইরী এবং লেখার খাতা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করান তিনি।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে প্রণীত, অনুমোদিত বা প্রকাশিত ব্যতীত অন্য কোন বই পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্তিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কুর্মিটোলা হাইস্কুলে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ শিশু থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ৩৮টি বই অতিরিক্ত পাঠ্য করা হয়েছিলো। এসব বই অতিরিক্ত পাঠ্য করায় ডোনেশনের নামে ৯ লাখ টাকা নেয়া হয়েছে প্রকাশনী সংস্থাগুলো থেকে। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ৫ থেকে ৮ শতাংশ কমিশনে এ বই কিনতে পারলেও ঘুষ না নিলে শিক্ষার্থীরা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমিশনে বই কিনতে পারতো। খালেকের ডোনেশন গ্রহণের ফলে অভিভাবকদের পকেট থেকে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ১৪ লাখ টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, চার হাজার ৫৩০ জন শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট প্রকাশনী মুদ্রিত ডাইরী এবং খাতা কিনতে বাধ্য করার ফলে অভিভাবকদের আরও কয়েকলাখ টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হয়েছে।
কুর্মিটোলা হাই স্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে দেয়া প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের চার সদস্যের অনাস্থাপত্রেও এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের কল্যাণের কথা চিন্তা না করেই অধ্যক্ষ দলীয় লোক দিয়ে ২০১৭ এবং ২০১৮ শিক্ষাবর্ষের ক্লাস রুটিন প্রস্তুত করেন। এতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বিষয় ভিত্তিক শিক্ষককে ক্লাস না দিয়ে প্রাথমিকের শিক্ষককে মাধ্যমিকের, মাধ্যমিকের শিক্ষককে কলেজের এবং কলেজের শিক্ষককে প্রাথমিকের ক্লাস দেওয়া হয়েছে। ভুগোলের শিক্ষক শিফট ইনচার্জ গোলাম মস্তুফাকে কোচিং বাণিজ্য করার সুযোগ দিতে ৮ম শ্রেণিতে গণিত পাঠদান করাতে দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগে আরো জানা গেছে, ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ দেখিয়ে একবার সহকারী প্রধান শিক্ষকের চাকরি হারিয়েছিলেন আব্দুল খালেক। পরে তদবির করে এ প্রতিষ্ঠানে ফের যোগ দিয়ে বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন তিনি। এছাড়া নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে প্রতিষ্ঠানের কল্যাণের কথা চিন্তা না করে অধ্যক্ষ নিয়োগ প্রদানে কোন এজেন্ডা কমিটির সভায় উপস্থাপন করেন না ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক। অথচ আব্দুল খালেক কুর্মিটোলা হাই স্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদে থেকে মোটা অংকের টাকা বেতনভাতা নিচ্ছেন।
এদিকে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পরিষদের চার সদস্য তাদের অনাস্থা পত্রে বলেছেন, বিভিন্ন সময়ে শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে ঘুষ গ্রহণ এবং নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করা হয়েছে। এর ফলে বিদ্যালয়ের শিক্ষাদান কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে।শিক্ষার্থীরা যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষকের পাঠগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ২৫ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করা হয়েছে। এর সঙ্গেও আব্দুল খালেক জড়িত।
অনাস্থাপত্রে আরও বলা হয়, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে সভাপতি এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের মনোনীত প্রার্থী রেজাউল পাস না করায় শিক্ষকদের ওপর তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মতামত না নিয়েই নিজ ক্ষমতা বলে ৪ জন শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করেন পরিচালনা কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম। এক বছরের মধ্যে ১০-১২জন শিক্ষককে শোকজ করা হয়েছে। আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও ২০১৭ খিস্টাব্দের নির্বাচনে নিজের প্রতিনিধিকে ভোট দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক। শিক্ষক জালাল উদ্দিনকে চাপ প্রয়োগ করা হয় রেজাউলকে ভোট দিয়ে ছবি তুলে আনার জন্য।
অনাস্থাপত্রে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি রফিকুল ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক যোগসাজেশে স্বজনপ্রীতি করে সভাপতির ভাই জালাল উদ্দিনকে লোক দেখানো নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ দেন। ঘটনাটি সভাপতির ভাই জালাল উদ্দিন নিজ কণ্ঠে স্বীকার করেছেন। এ নিয়োগের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা রয়েছে। মামলার কারণে জালাল উদ্দিনের বেতনের সরকারি অংশ বন্ধ থাকার পরেও সভাপতির ক্ষমতার প্রভাবে প্রতিষ্ঠান থেকে বেতনের সরকারি অংশ পরিশোধ করা হচ্ছে। যা নজিরবিহীন।
কোন বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই নিজের ক্ষমতা বলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক প্রায় ১৫ থেকে ১৬ বছর পূর্বে সাধারণ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া রেজাউল হককে ‘সংশোধিত’ নিয়োগপত্র দিয়ে গণিতের শিক্ষক পদে বসান। এছাড়াও কোচিং ব্যবসা জমজমাট করতে ২০১৭ ও ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ৮ম থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত গণিতের সর্বোচ্চ ক্লাস বরাদ্দ দেওয়া হয় রেজাউল হককে।প্রতিষ্ঠানে সহকারী প্রধান শিক্ষক থাকার পরেও জেষ্ঠ্যতার ভিত্তিত জুনিয়র গোলাম মোস্তফাকে শিফট ইনচার্জ পদে নিযুক্ত করে প্রতিষ্ঠানের টাকার অপব্যবহার করা হচ্ছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, পরিচালনা পরিষদের সভায় অভিভাবক প্রতিনিধিদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সভাপতির সকল সিদ্ধান্ত পাস করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কথা বলতে চাইলে সভাপতি গালিগালাজ করেন এবং বিভিন্ন হুমকি প্রদর্শন করেন।
অধ্যক্ষ শিক্ষকদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করেন। এর ফলে শিক্ষকদের দলাদলি চরম আকার ধারণ করেছে।
অনাস্থা পত্রে বলা হয়, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রতিষ্ঠানে যথাযথ সময় দেন না। তিনি শিক্ষক ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়ে সময়ক্ষেপন করেন এবং প্রতিষ্ঠানের ক্লাস বন্ধ রেখে লেখাপড়ার চরম ক্ষতি করে যাচ্ছেন।
ভুয়া সনদের বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, আমি বিএসসি বিএড পাস। আমি সহকারী শিক্ষক প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ নই, অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছি। ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদের অভিযোগটি সত্য নয়। অভিজ্ঞতার সনদ দাখিল না করলে চাকরি হয় না।
অননুমোদিত পাঠ্যবইয়ের ব্যপারে জানতে চাইলে আব্দুল খালেক বলেন, এনসিটিবি অননুমোদিত পাঠ্যবইয়ের ব্যাপারে আমার জানা নেই। আর প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের জন্য ডাইরি সরবরাহ করার কথা ছিলো। ডাইরী ও খাতা মুদ্রণে প্রতিষ্ঠান থেকে টেন্ডার দেয়া হয়েছিলো। আর যারা টেন্ডার পায় তারা প্রতিষ্ঠানে ডোনেট করে থাকেন।
শিক্ষক অভিভাবকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং শিক্ষকদের বরখাস্তের বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুল খালেক দুর্ব্যবহারের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বললে আমার ব্যবহার সম্পর্কে সত্যটি জানতে পারবেন। আর প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ কাউকে একা বরখাস্ত করতে পারেন না। এখানে কমিটির সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
শিক্ষক গোলাম মোস্তফাকে গণিতের ক্লাস দেয়ার বিষয়ে অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, গোলাম মোস্তফা সব সময়ই গণিতের শিক্ষক। আমার নিয়োগ ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে, আমি এসে উনাকে গণিতের শিক্ষক হিসেবেই পেয়েছি। তবে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট নতুন করে রেজাউলকে কেন আবার নিয়োগপত্র দেয়া হলো সে বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।