কেন এত পরীক্ষা বাংলাদেশে? - দৈনিকশিক্ষা

কেন এত পরীক্ষা বাংলাদেশে?

শিশির ভট্টাচার্য্য |

প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত যে তিন স্তরবিশিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা গত শ দেড়েক বছর ধরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি—এটি আমাদের দেশের নিজস্ব উদ্ভাবন নয়। এ শিক্ষাব্যবস্থা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোর সঙ্গে পাশ্চাত্য থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এবং ব্যবস্থাটিকে আমরা আমাদের স্বভাবদোষে দিনকে দিন জটিলতর করে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারছি।

১৮ বছর বয়স পর্যন্ত পাশ্চাত্যের বেশির ভাগ দেশে যেখানে একটি মাত্র মাধ্যমিক ডিগ্রি আছে, বাংলা অঞ্চলে সেখানে সব সময়ই ছিল দুটি ডিগ্রি: মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক। এখন পুরোনো দুই গোদের ওপর নতুন দুই বিষফোড়া যোগ হয়েছে: প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক। এর মানে হচ্ছে পাশ্চাত্যের তুলনায় প্রথম দুই স্তরে আমাদের শিক্ষার্থীরা চার গুণ বেশি চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে থাকে।

পাশ্চাত্যে প্রথম দুই স্তরের পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে না। কিন্তু বাংলাদেশে যেকোনো পরীক্ষায় পাস করলেই শুধু চলে না, সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে পাস করতে হয়। সর্বোচ্চ নম্বর না পেলে হতাশায়-অপমানে আত্মহত্যার ঘটনাও বিরল নয়। এত কষ্ট করে পাস করা পরীক্ষাগুলোর তেমন কোনো মূল্য নেই এই অর্থে যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় শতভাগ নম্বরও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির নিশ্চয়তা দেয় না। শুধু তা–ই নয়, উচ্চমাধ্যমিকে উচ্চ নম্বরধারীদের মধ্যে অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বরও পায় না।

চারপাশে প্রায়ই লোকজনকে আমরা বলতে শুনি, ‘আজকাল তো লেখাপড়া নেই, শুধু পরীক্ষা আছে!’ পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়েছেন যে শিক্ষামন্ত্রী, তিনি যদিও একাধিকবার পরীক্ষার সংখ্যা কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেই প্রতিশ্রুতি কার্যে পরিণত করা কার্যত অসম্ভব। কারণ, ব্যক্তি বাঙালি এবং বাঙালি সমাজ অতিমাত্রায় পরীক্ষাপ্রবণ। এখানে কামলা হতে পরীক্ষা, আমলা হতে পরীক্ষা, ভবিষ্যতে শুনছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলেও দিতে হবে পরীক্ষা। বাঙালি জাতির এই অতিমাত্রার পরীক্ষাপ্রবণতার কারণ কী?

জ্ঞানচর্চার জন্য অর্থনৈতিক উন্নতি অপরিহার্য। একাদশ-দ্বাদশ শতকে মুখ্যত অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং আনুষঙ্গিক একাধিক কারণে পরবর্তী কয়েক শতক ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যাশিক্ষা করার পর পাশ্চাত্যের মানুষ জ্ঞানচর্চায় সক্ষম হয়ে উঠেছিল। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিকভাবে বঙ্গ, বিশেষত পূর্ববঙ্গ ছিল ভারতবর্ষের সর্বাপেক্ষা অবহেলিত অঞ্চলগুলোর একটি। চর্যাপদের যুগে যখন বাঙালি সত্তার কমবেশি উন্মেষ হচ্ছে, তখনো বাঙালি হতদরিদ্র। ‘টালত মোর ঘর নাহি পরবেষী। হাঁড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী।’ কালক্রমে কৃষি ও শিল্পে কমবেশি সমৃদ্ধি এলেও বাংলার আর্থিক অবস্থা কখনোই এতটা উন্নত হয়ে ওঠেনি যে এই বাংলা অঞ্চল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র এবং বাংলা ভাষা জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হয়ে উঠবে।

ঔপনিবেশিক আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি দেওয়া শুরু হওয়া মাত্র বাঙালি মুক্তকচ্ছ হয়ে ডিগ্রি পেতে ছুটেছিল এবং এখনো ছুটছে। কারণ গড় বাঙালি মনে করে, ডিগ্রি মানেই একটি চাকরি এবং চাকরি মানেই বৈষয়িক উন্নতির দরজা খুলে যাওয়া।

গড় বাঙালি সম্ভব হলে প্রতি ক্লাসেই একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে একটি সনদ পেতে চায়। ব্যক্তিপর্যায়ে এর কারণ ঈর্ষা, স্বর্গীয় চাপ বা পিয়ার গ্রুপ প্রেশার এবং অন্তঃসারশূন্য এক শ্রেণিবোধ। প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়ের সন্তানের তুলনায় আমার সন্তানের বেশি ডিগ্রি থাকতেই হবে। শুধু তা–ই নয়, তাকে অবশ্যই বেশি নম্বর পেতে হবে এবং তথাকথিত ‘ভালো’ স্কুলে পড়তে হবে।

বাঙালি সমাজ ডিগ্রিমুখী এবং পরীক্ষামুখী হওয়ার কারণে অনেকেই আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। প্রতিটি ডিগ্রির সঙ্গে জড়িত রয়েছে গাইডবুক মুদ্রণ, কোচিং, দৈনিক-সাপ্তাহিক-মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক, বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন মুদ্রণ এবং প্রশ্নফাঁস, মিষ্টান্ন প্রস্তুত ও বিক্রয়সহ নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। মোট কথা, বাংলাদেশের অর্থনীতির অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত এই পরীক্ষা এবং এই খাত থেকে রাষ্ট্রের বার্ষিক আয় পরিচিত অনেক খাতের চেয়ে অনেক বেশি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরীক্ষার সংখ্যা দিন দিন বাড়াবে, কারণ পরীক্ষার চাহিদা আছে এবং কে না জানে যে অর্থনীতির অমোঘ নিয়মে চাহিদা থাকলে সরবরাহ থাকবেই।

এই ডিগ্রিমুখী মানসিকতা কিংবা শিক্ষানীতির অব্যবহিত ফল হচ্ছে সেমিস্টার পদ্ধতি। বছরে একাধিক সেমিস্টার। প্রতি সেমিস্টারে ভর্তি, টিউশনসহ রাজ্যের ফি দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীর অভিভাবকের পকেটের সর্বনাশ, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকপক্ষের পৌষ মাস। বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাখা হয়েছে চার–চারটা সেমিস্টার, যাতে সাততাড়াতাড়ি বিদ্যা কিনে সার্টিফিকেটখানি আপনি পকেটে পুরতে পারেন এবং মালিকপক্ষ বিদ্যা বেচে মুনাফার টাকা ব্যাংকে তুলতে পারে।

ভর্তি হতে না–হতেই কুইজ, মিডটার্ম, প্রেজেন্টেশন, ফাইনাল পরীক্ষার ধাক্কায় জেরবার শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা পাসের বাইরে কোনো কিছু চিন্তাই করতে পারে না। চার–চারটা সেমিস্টার পাস করার ইঁদুরদৌড়ে আমাদের সন্তানদের জীবন থেকে বিতর্ক-আলোচনা, সংস্কৃতিচর্চা, খেলাধুলা ও বই পড়ার অভ্যাস হারিয়ে যাচ্ছে। সেমিস্টার পদ্ধতিতে চিন্তা ও বিশ্লেষণ শক্তিহীন কিছু ডিগ্রিধারী রোবট তৈরি করতে আমরা হয়তো সক্ষম হচ্ছি, কিন্তু সংস্কৃতিমান ও সৃজনশীল মানুষ তৈরি করতে পারছি কি? বাংলাদেশের গ্রামে একসময় দুই খোন্দ ধান হতো, শীতে ধানের খেত খালি পড়ে থাকত যেখানে মৌসুমি খেলাধুলা করতে পারত শিশু–কিশোরেরা। আজ তিন বা চার খোন্দ ধান করতে গিয়ে কোনো ধানখেত সম্ভবত আর খালি নেই। এতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ আমরা হয়তো হচ্ছি, কিন্তু অংশগ্রহণমূলক বিনোদন ও ক্রীড়াচর্চাহীন যে জীবন আমরা যাপন করছি, তা কি আদৌ যাপনের উপযুক্ত?

‘ভর পেটে দৌড়াতে নেই, চিবিয়ে খাওয়া স্বাস্থ্যকর। ডিগ্রি আগে বাগাই দাদা, প্রাণ বাঁচানো তারপর।’ সৃজনশীলতার ভড়ং দেখিয়ে প্রকৃতপক্ষে গাইডবুক থেকে এককালীন, একগাদা তথ্য মুখস্থ করে সে তথ্য পরীক্ষার খাতায় হুবহু উগরে দিয়ে আমরা ডিগ্রি পাচ্ছি সত্য, কিন্তু বাধ্য হয়ে গেলা আর স্বাদ অনুভব করে চিবিয়ে খাওয়া কি এক? মনের আনন্দে মানুষ হাঁটতে পারে, কিন্তু সৈনিকমাত্রেই বাধ্য হয়ে মার্চ করে। সৈনিকদের মতো চৌকসভাবে মার্চ করতে গিয়ে আমরা মানুষের মতো হাঁটতে ভুলে যাচ্ছি। গড় বাঙালির অধ্যয়নের সঙ্গে আনন্দের যোগ নেই, যদিও (রবীন্দ্রনাথের মতে) লেখাপড়া বা জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে আনন্দই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত ছিল।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক

 

 

কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029349327087402