কে জি ভাইকে নিয়ে কিছু লিখব বলে অনেকদিন ধরেই ভাবছি। কিন্ত কী লেখা যায়? আমার সাথে কে জি ভাইয়ের পরিচয় আশির দশকের শুরুর দিকে। কিন্তু তখন কে জি ভাইয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠেনি। কে জি ভাই তখন ডিএফপি থেকে প্রকাশিত সচিত্র বাংলাদেশ পত্রিকার সম্পাদক। একজন সম্পাদক আর নবীন ফটোসাংবাদিকের মধ্যে ব্যবধান বিস্তর। বন্ধু মাসুদের মাধ্যমে যাতায়াত ছিল আমার। মাঝে মাঝে যেতাম তাঁর অফিসে। চা-বিস্কুট খেতাম।
কে জি ভাই অবসরে যাওয়ার পর নিয়মিত প্রেসক্লাবমুখো হলেন। তিনি প্রেসক্লাবে এলেই আমার সাথে আড্ডা হতো। শুনতে পেতাম তার কত কথা, কত স্মৃতি। আস্তে আস্তে কথা বলতেন কে জি ভাই। মনোযোগ সহকারে শুনতাম তার গল্পগুলো। কীভাবে কখন কোথায় কোন গান, কোন কবিতা রচনা করেছেন সেই সব গল্প, সে সবের স্মৃতিচারণ। একদিন খুব খোশমেজাজে ছিলেন কে জি ভাই। আমাকে বললেন, জানেন আমি বেশিরভাগ সময় লজিং থেকে লেখাপড়া করেছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর হলে থাকতেন আর টিউশনি করতেন। সে কথাও জানান। সে সময় তিনি কবিতা লিখতেন। আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন তার সিনিয়র সহপাঠী। একদিন কেজি ভাইয়ের কবিতার খুব প্রশংসা করলেন আবু হেনা এবং তাকে গান লিখতে উদ্বুদ্ধ করলেন। তারপর থেকে গান লেখা শুরু করলেন কে জি ভাই। তার লেখা গান রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচার হওয়া শুরু হলো। একবার কে জি ভাই জানতে পারলেন, সেদিন বিকাল চারটায় রেডিওতে তার লেখা গান প্রচার হবে। তখন তিনি টিউশনি করেন হাটখোলা রোডের একটি বাড়িতে। ছাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন তাদের বাড়িতে রেডিও আছে কিনা। জবাবে তার ছাত্রী জানালেন, না। পাশেই আজিম কাকার বাড়ি। তাদের রেডিও আছে। আজিম-সুজাতা তখন ঢাকার চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় জুটি। ছাত্রীর মা ওই বাড়িতে গিয়ে অনুরোধ করলেন, তাদের মাস্টারের লেখা গান প্রচার হবে বিকাল চারটায়। মাস্টার সা’ব এই গানটা শুনবে। তোমরা রেডিওটা একটু জোরে ‘বাজাইয়ো’। সে দিন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিজের লেখা গান শুনলেন কে জি ভাই।
এর কয়েকদিন পরে কে জি ভাইয়ের হলে গিয়ে হাজির হলের নায়ক আজিম এবং আরো কয়েকজন লোক। কে জি ভাইকে গাড়িতে করে তারা নিয়ে আসেন পুরান ঢাকার একটি বাড়িতে। সেখানে কাগজ-কলম দিয়ে একটা জায়গায় বসিয়ে দেন এবং একটি গান লিখতে বলেন। পুরান ঢাকার অনেক ধরনের মজাদার খাবার-দাবার এনে তার সামনে রাখা হয়।
ভালো ভালো খাবার খেয়ে গান লিখতে বসলেন কে জি ভাই। অথচ কী লিখবেন মাথায় কিছুই আসছে না! সারারাত কসরত করার পরও কোনও গানই লেখা হলো না। সকালে তারা এসে দেখলেন গান লেখা হয়নি। একজন ক্ষেপে বললেন, কিসের গীতিকার তুমি ছবির জন্য একটা গানও লিখতে পারো না। তাকে ভালো-মন্দ অনেক কথা শোনানো হলো। ভয়ও দেখান হলো। কিন্তু কিছুই হলো না। সন্ধ্যার দিকে আবার কয়েকজন লোক আসলেন। সারাদিন অনেক রকমের মজাদার খাবার কেজি ভাইকে দেওয়া হলো। কিন্তু এবারে কোন খাবারেই তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না তিনি। গলা দিয়ে খাবার নামছিল না। সন্ধ্যায় এলেন একজন ভদ্রলোক। তিনি ঘর থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে কে জি ভাইয়ের সঙ্গে গালগল্প জুড়লেন। লোকটিকে আগে কখনো দেখেননি বা চেনেনও না কে জি ভাই। ভদ্রলোকে বলছেন, সেই ছবিতে নায়ক নায়িকার সাথে কী ভাবে দেখা হবে। এই সাক্ষাতের পরে নায়িকাকে উদ্দেশ্য করে নায়ক একটি গান গাইবেন। এখন গানটি কী হতে পারে? এই আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে কে জি ভাই দিকনির্দেশনা পেলেন। লিখলেন, তোমারে লেগেছে এত যে ভাল… বলতে বলতেই ভদ্রলোক টেবিল চাপড়ে গুনগুন করে সুর করে ফেললেন। বললেন, হ্যাঁ তারপর কী তারপর কী? কে জি ভাইও উৎসাহ সহকারে একের পর এক পঙক্তি বলে যাচ্ছেন আর ওই ভদ্রলোক টেবিল চাপড়ে চাপড়ে সুর তুলে ফেলছেন। সঙ্গে সঙ্গে কে জি ভাই ওই কথাগুলো লিখে ফেলছেন। এই ভাবেই বিখ্যাত গানটির সৃষ্টি হলো। পরে কে জি ভাই জানতে পারলেন ওই ভদ্রলোক আর কেউ নন উনি হলেন পাকিস্তানের বিশিষ্ট সুরকার রবিন ঘোষ।
পরের দিন কে জি ভাইকে নিয়ে যাওয়া হলো একটি স্টুডিওতে। যেখানে অপেক্ষা করছিলেন বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী তালাত মাহমুদ। তিনি এই গানটির সুরকার রবিন ঘোষের কাছ থেকে রেকর্ডিং এর আগে গান গাওয়ার রিহার্সেল দিচ্ছিলেন। কেজি ভাইয়ের লেখা গানটির দুই একটি শব্দ শিল্পী তালাত মাহমুদে মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না। তখন কে জি ভাইকে দিয়ে সে সব শব্দ পরিবর্তন করে দেওয়া হলো। পরিবর্তনের পর গানটি রেকর্ডিং হলো। এ ভাবেই জন্ম নিলো হৃদয় আকুল করা গান। আর গানটি অমর হয়ে রইল।
কিন্তু, কে জি ভাই এর গান নিয়ে অনেক আগেই আমার অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। আমি যখন ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার চিফ ফটোজার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করেছি, তখন সম্পাদকের সঙ্গে রাজশাহীতে যাই। আমাদের সাথে দৈনিক মুক্তকণ্ঠের সম্পাদক আরেকজন কে জি মোস্তফাও ছিলেন। তিনিও সাংবাদিক। তিনিও আমাদের সফর সঙ্গী হন। সেদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান আমাদের আমন্ত্রণ মুক্তকণ্ঠের সম্পাদক কে জি মোস্তফাকে। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সাংবাদিকতার বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকেন। একপর্যায়ে এক ছাত্র কে জি মোস্তফা ভাইকে বলেন, স্যার আমরা আপনার অনেক ভক্ত। আপনাকে কখনো দেখিনি। কিন্তু আপনার লেখা গানটি আমরা ক্যাম্পাসে গেয়ে থাকি। তিনি জানতে চাইলেন, কোন গানটি? উত্তরে ছাত্রটি বললেন, তোমারে লেগেছে এত যে ভাল চাঁদ বুঝি তা জানে। এবারে তিনি বললেন, তাই নাকি! আরেকজন বললেন, আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন। কেজি ভাই বললেন, তাই নাকি! তাই নাকি! বাহ! খুব ভালো! খুব ভালো!
আমি তখন জানতাম না ওই গানের আসল গীতিকার কে?
তিন চার মাস পরে একদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে বসে আছেন গীতিকার কে জি ভাই। আমি তখন তাকে উদ্দেশ্য করে বলি যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কে জি ভাইকে খুব সম্মান করেছে। তার গানের খুব প্রশংসা করেছে। আমার কথা শুনে কে জি ভাই আস্তে করে উঠে চলে গেলেন। পরে আমাদের এক সহকর্মী সিনিয়র সাংবাদিক শামসুদ্দিন আহমেদ চারু ভাই বললেন, কে বলেছে তিনি ওই গান লিখেছেন। গান তো লিখেছে আমাদের এই কে জি ভাই।
তিনি তখন হোমিও ডাক্তার হিসেবে পরিচিত। সাংবাদিক, কবি, গীতিকার ও হোমিও চিকিৎসক কে জি মোস্তাফা ভাই। আজ থেকে ১৯ বছর আগে কবিতাপত্র নামে জাতীয় প্রেসক্লাবের একটি প্রকাশনা বের হওয়া শুরু হয়। শুরু থেকেই কে জি ভাই সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। মাসের শেষ তারিখে আমাকে নিয়মিত ওই অনুষ্ঠানের ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করতে হতো। আমি কবি নই, তবে কবিতা ভালোবাসি, তাই নিয়মিত যাতায়াত ছিল কবিতাপত্রের সেই অনুষ্ঠানে। এটা ছিল অনেকটা কে জি ভাইয়ের ভালোবাসার কারণেই।
কে জি ভাই তার জীবনের অনেক কথা, অনেক অজানা গল্প আমার সাথে শেয়ার করতেন। আমি একদিন কে জি ভাইকে অনুরোধ করলাম, আমাদের বার্তা নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করছে, আমাদের ছোট ভাই সিদ্দিকুর রহমান খান। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার একটি যোগাযোগ আছে, প্রতিষ্ঠানটিকে শুধু সিদ্দিকুর রহমান খানের প্রতিষ্ঠান মনে করি না, এটা আমার একটি প্রতিষ্ঠান মনে করি। সেই কারণেই কেজি ভাইকে অনুরোধ করি দৈনিক আমাদের বার্তার জন্য কিছু লেখেন। কবিতা বাদে, গল্প-প্রবন্ধ এই ধরনের কিছু স্মৃতিকথা নিয়ে তার সাথে আমি প্রেসক্লাবের তিনতলায় কম্পিউটার রুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আলাপচারিতা করতাম। নিচতলায় চায়ের টেবিলে বসে কথা বলতাম, কী লেখা যায় কীভাবে কোনটা লেখা যায়। তারপর এগুলো লিখে আমার মেইলে পাঠিয়ে দিতেন।।
মৃত্যুর ৩৬ ঘণ্টা আগে আমাকে চারটি লেখা পোস্ট করেছিলেন আমাদের প্রেসক্লাবের কম্পিউটার বিভাগের আসাদ হাওলাদার এর মাধ্যমে। আরও কয়েকটি লেখা ঠিক করে রেখেছিলেন কয়েকদিন পরে পোস্ট করবেন বলে। সেগুলো পোস্ট করা আর হলো না। সে লেখাগুলো প্রকাশ করতে পারলাম না।
আল্লাহ আমাদের কেজি ভাইকে বেহেশত নসিব করুন। কে জি ভাই বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ের মাঝে। আমাদের প্রেসক্লাবের একটি সঙ্গীত আছে, প্রেসক্লাব আমাদের সেকেন্ড হোম, এই গানটিও তিনি রচনা করেছেন। শত শত গান, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, লিখেছেন কে জি ভাই। তার কয়টিই বা প্রকাশ পেয়েছে? আর কতটুকুই বা জানা আছে কে জি মোস্তফা সম্পর্কে?
লেখক: বুলবুল আহমেদ, ফটো এডিটর, দৈনিক আমাদের বার্তা ।