কোচিং বন্ধের নিদের্শনা ছিল অনেক আগে থেকেই। আমাদের দেশে আইনের অভাব নেই। কিন্তু সে আইনের প্রয়োগ না থাকায় অনেক অনিয়মই ভয়ংকর রূপ ধারণ করে কালক্রমে। কোচিং বন্ধের নির্দেশনা থাকলেও তা এতদিন না মানার কারণে ধীরে ধীরে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে শিক্ষকদের মধ্যে। কোচিং সেন্টার আর ক্লিনিক যে হারে ব্যাঙের ছাতার মতো যত্র তত্র গড়ে উঠেছে তাতে মনে হচ্ছে এদেশে শিক্ষা আর চিকিৎসায় বাম্পার উৎকর্ষ সাধন হয়েছে। এর ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হারাচ্ছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা।
মানুষের আয়ের সিংহভাগই চলে যাচ্ছে শিক্ষা আর চিকিৎসার পেছনে। এদেশের মধ্যবিত্তরা শিক্ষার ব্যয় বহন করতে গিয়ে দিশেহারা।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে কোচিং বাণিজ্য শুরু হয়েছিল যখন তখন এটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়নি। ফলে ধীরে ধীরে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে গণিত এবং ইংরেজি শিক্ষকদের ব্যক্তিগত কোচিং সেন্টার গড়ে ওঠে। ক্লাসে ক্লাসে চলে তাদের কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন। নানাভাবে মানসিক নির্যাতনের সম্মুখীন হয় শিক্ষার্থীরা এই বাণিজ্যের কাছে। ফলে শিক্ষক হারায় শ্রদ্ধা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা নিয়ে গড়ে ওঠে ব্যক্তিগত কোচিং সেন্টার। সাইফুর’স, উন্মেষ, উদ্ভাস, ইউনিভার্সসহ নানা কোচিং সেন্টারগুলো তাদের শিকড়-বাকড় এতটাই মজবুত করে বিস্তার করেছে যে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন নীরব। কোচিংয়ের কুফল যখন শিক্ষার নানা ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার শুরু করছে এবং এই কুফল শুধু মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকেই নয় প্রাথমিকেও সমাপনীর কল্যাণে একই রূপে আবির্ভূত এখন টনক নড়েছে প্রশাসনের। এখন আইন করে, দৌড়-ঝাপ করে কোচিং বন্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। সারা বাংলাদেশে এখানে সেখানে মান বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন, মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ সর্বত্র প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানাভাবে, নানা উপায়ে যেখানে কোচিং ফি আদায় করা হচ্ছে সেখানে কতজন শিক্ষককে ধরে কারাগারে প্রেরণ করবে প্রশাসন?
কোচিং কি শুধুই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে সমাজে? না, কোচিংয়ের কিছু সুফলও আছে। যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সময় শেষে শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত রাখার একটি উপায় কোচিং। ব্যক্তিগতভাবে বাসায় প্রাইভেট পড়াতে গিয়ে অভিভাবকদের যে অর্থ ব্যয় হয় তার চেয়ে অনেক কম খরচে কোচিংয়ে লেখাপড়া করা যায়।
শিক্ষার্থী শিক্ষক অনুপাত না কমিয়ে, শিক্ষকদের জন্য মানসম্মত বেতনের ব্যবস্থা না করে, পাঠ্যপুস্তক সময়োপযোগী না করে হঠাৎ করে কোচিং বন্ধের নামে কোথাও কোথাও শিক্ষকদের ধরে তাদের অপরাধীর কাঠগড়ায় নিয়ে যাবার অর্থ শিক্ষকদের মর্যাদার আসনটি নড়বড়ে করে দেয়া।
শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের অপরাধী করার অর্থ পুরো জাতিই অপরাধী। কারণ সারা বাংলাদেশে হাতে গোনা কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া এমন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে কোচিংয়ের ব্যবস্থা নেই। এদেশের ক্লিনিকগুলো যেমন কোন না কোন ডাক্তারের, তেমনি কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো কোন না কোন শিক্ষকের।
সম্প্রতি কোচিং সেন্টার বন্ধের জন্য নানা কোচিং সেন্টারে আচমকা হানা দেয়া হচ্ছে। আবার বলা হচ্ছে শিক্ষকরা বাসায়ও ব্যক্তিগতভাবে পড়াতে পারবেন না। এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অভিভাবকরা প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষার্থীদেরই পড়াতে সক্ষম নন। বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বিদ্যালয়ের পড়া বিদ্যালয়ে শেষ করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া পাঠ্যপুস্তকগুলোও সহজবোধ্য নয়।
সমাজে একটা সময় শুধু বিত্তবানরাই স্কুলের বাইরে প্রাইভেট পড়ত। কিন্তু কালক্রমে নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সকলের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, কোচিং না করলে পরীক্ষায় পাস অসম্ভব। আইন করে কোচিং বা ব্যক্তিগত প্রাইভেট বন্ধ করলে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের উপর। কারণ তখন কোন না কোন উপায়ে অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে উচ্চবিত্তের সন্তানরা পড়বে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত এখনই হিমশিম খায় তখন তাদের অবস্থা আরো করুণ হবে। তারা না পারবে লেখাপড়া বাদ দিতে, না পারবে উচ্চমূল্যে লেখাপড়া অর্জন করতে। নিম্নবিত্ত লেখাপড়া থেকে সরে এসে কাজে লেগে যাবে।
কোচিংকে নিষিদ্ধ না করে তাকে নীতিমালায় নিয়ে আসাই হবে যুক্তিযুক্ত। স্কুলের নির্ধারিত সময়ের পর, একটা নির্ধারিত অর্থে, বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক যদি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোচিং করে বিদ্যালয় ভবনে তা হলে, অবাধ অর্থ উপার্জন, শিক্ষকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, নিরাপত্তার অভাব, একজন শিক্ষকের ৪০/৫০ শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে পড়ানো এ ধরনের নানা সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে।
কোচিং বন্ধের নির্দেশনা প্রদানের পূর্বে শিক্ষকদের উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কারণ কালক্রমে দারিদ্রতার করাল গ্রাস থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়েই ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে কোচিং। শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরা করে শিক্ষকদের অবসর পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে শিক্ষকদের উন্নত জীবন, সামাজিক মর্যাদা, মেধার বিকাশ, সঠিক পদোন্নতি এসব নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়।
শিক্ষাক্ষেত্রে চলছে লেজে-গোবরে অবস্থা। মেধাবীদের এখানে আগ্রহ নেই, রাষ্ট্রের পুলিশী আচরণ, সমাজের বিদ্রুপাত্মক মনোভাব গুরু নয়, অনুগত কর্মচারি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। চোর-পুলিশ খেলা বাদ দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে কোথায় অনিয়ম, কী অনিয়ম তা নির্ধারণ করার জন্য মাঠ পর্যায় থেকে সুপারিশ নিয়ে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে নিত্য নতুন গবেষণা চালিয়ে তাদের গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহার করে আর শিক্ষকদের বানর নাচ নাচিয়ে শিক্ষার উন্নয়ন অসম্ভব।
শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত মেধাবী শিক্ষকদের নিয়েই খুঁজতে হবে সমাধান। অভিজাত হোটেলে খেতে খেতে নিরন্ন মানুষের খাদ্য সমস্যার সমাধান খুঁজলে হবে না। যারা সমস্যার সঙ্গে জড়িত তাদের নিয়েই গড়তে হবে কমিটি। আমাদের প্রয়োজনেই শিক্ষকদের অপরাধী নয়, আদর্শ হিসেবে গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করতে হবে।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া: শিক্ষক
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]