খাতা মুল্যায়ন ও পরীক্ষকদের সম্মানী প্রসঙ্গে - দৈনিকশিক্ষা

খাতা মুল্যায়ন ও পরীক্ষকদের সম্মানী প্রসঙ্গে

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

আমাদের শিক্ষায় অনেক সাফল্য। এ সব কৃতিত্ব অস্বীকারের উপায় কারো নেই। ঝরে পড়া রোধ, বিনেমুল্যে পাঠ্য পুস্তক বিতরণ, উপবৃত্তি প্রদান, স্কুল-কলেজে সুদৃশ্য ভবন নির্মাণ, নারী শিক্ষার প্রসার, শিক্ষায় আইসিটি’র প্রয়োগ ইত্যাদি বহুমুখী সাফল্যের একেকটি মাইল ফলক।

কিন্তু, তদুপরি এখন ও আমাদের শিক্ষায় বহুমাত্রিক ব্যর্থতা। এর মধ্যে নোট-গাইড ও কোচিং এবং প্রশ্নফাঁস ও পরীক্ষার খাতা মুল্যায়নের নানাবিধ অব্যবস্থাপনা সব সাফল্যকে ম্লান করে দেয়। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনকারী এক মহাবীরের জাতি আমরা। কিন্তু, কেন জানি কোন অদৃশ্য কারণে আমরা নোট-গাইড ও কোচিংয়ের বিরুদ্ধে জেহাদে নেমেও বার বার রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে আসি। কেন যে এর সাথে বার বার আপোস করি।

সে যাকগে, পরীক্ষার খাতা মুল্যায়ন ও পরীক্ষকের সম্মানী বিষয়ে আজ একটু বিশদ আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করি। আসলে আমাদের গোটা পরীক্ষা ব্যবস্থাই এখন বিতর্কের জালে জড়িয়ে আছে। এর শেঁকড় সন্ধান করে বের করতে হবে। বর্তমানে পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি। কিন্তু, গবেষণায় জানা যায়-দেশের বিভিন্ন স্তরের অর্ধেক শিক্ষকই সৃজনশীল প্রশ্ন কী জিনিস তা বুঝেন না। তাই পরীক্ষা এলেই পরীক্ষার প্রশ্নের মান নিয়ে নানা কথা ওঠে। এদিকে প্রশ্নফাঁস জাতির গলায় ফাঁসের মত ঝুলে আছে। কখন সে ফাঁসে ঝুলে মরে যাই-সে চিন্তা আমাদের। আজ পর্যন্ত কোন একজন প্রশ্ন ফাঁসকারীর কঠোর শাস্তি হতে শুনিনি। প্রশ্ন ফাঁসকারী এক দু’টো বদমাসকে চুলীতে লটকিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিলে আর হয়তো কোনদিন কেউ এ কাজে সাহস পেত না।

আমাদের পরীক্ষার খাতা মুল্যায়ন নিয়ে নানা মুখরোচক কথা প্রচলিত আছে। অনুসন্ধানে জানা যায়-অধিকাংশ পরীক্ষক নাকি নিজে পরীক্ষার খাতা না দেখে অন্যকে দিয়ে দেখান। সর্ব সাম্প্রতিক এর কিছু প্রমাণ হাতে নাতে পাওয়া গিয়েছে। এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে-সে আজ আমাদের খতিয়ে দেখা একান্ত প্রয়োজন।

আমি যেখানে সুযোগ পাই, সেখানে এ নিয়ে কিছু কথা বলি। যেখানে সুযোগ পাই, সেখানে এ নিয়ে কিছু লিখে থাকি। গত ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট (BEDU) আয়োজিত একটি কর্মশালার সমাপনী অধিবেশনে আমার বক্তব্যেও সে কথাগুলোই বলেছি।

প্রথমত: প্রত্যেক পরীক্ষক ২৫০ থেকে ৫০০টি করে দেখার জন্য খাতা পেয়ে থাকেন। প্রধান পরীক্ষক ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০টি করে খাতা দেখে থাকেন। একজন পরীক্ষক বা প্রধান পরীক্ষক নিশ্চয় একজন শিক্ষক মানুষ। ঘুম-নিদ্রা এবং খাওয়া-দাওয়া ও স্কুল-কলেজের সময় বাদে প্রতিদিন আর ক’ঘন্টা সময় তার হাতে থাকে? এমতাবস্থায় একজন শিক্ষক সামান্য দশ-বার দিনে এতগুলো খাতা দেখেন কী করে? তাই, তিনি বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে খাতা দেখা শেষ করতে গিয়ে হয় অন্যের সহযোগিতা নেন কিংবা নিজে যেনতেন ভাবে খাতা দেখে শেষ করে দেন। তাই, বেশীর ভাগ খাতা যথাযথ মুল্যায়ন করা সম্ভব হয় না।

দ্বিতীয়ত: তাড়াহুড়ো করে কম সময়ের মধ্যে রেজাল্ট দিয়ে কৃতিত্ব নেবার একটা মানসিকতা আমাদের বেশ কিছুদিন থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এটি মোটে ও শুভ নয়। এতে ভুলত্রুটির অবকাশ থেকে যায়। ফল ওলঠ পালঠ হয়। ধীরে-স্থিরে একটু সময় নিয়ে খাতা মুল্যায়ন করলে ফল বহুলাংশে সঠিক হয়ে থাকে। তাড়াহুড়োর কাজে ভুল বেশী থাকাই স্বাভাবিক।

তৃতীয়ত: প্রধান পরীক্ষক পরীক্ষকগণকে যে নমুনা উত্তরপত্র (sample answer) সরবরাহ করে থাকেন, তাকে একমাত্র সঠিক উত্তর মনে করা ঠিক নহে। এর বাইরে ভিন্ন উপায়ে শিক্ষার্থী সঠিক উত্তর লিখতে পারে। কোন পরীক্ষক যদি পুরোটা নমুনা উত্তর নির্ভর হয়ে পড়েন, তাহলে পরীক্ষার্থীর সমুহ সর্বনাশ। এ বিষয়টি ও খেয়াল রাখতে হবে। অনেক পরীক্ষক আছেন, যারা নমুনা উত্তর ছাড়া খাতা দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না-তাদের দিয়ে খাতা না দেখানোই ভাল।  গণিত ও ইংরেজি বিষয় ব্যতীত অন্য সব বিষয়ে পরীক্ষকগণকে নমুনা উত্তর ছাড়া কেবল লিখিত নির্দেশনা (guide line) সরবরাহ করা উচিত। এ বিষয়টি ভাল ভাবে ভেবে দেখা দরকার।

চতুর্থত: যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়ে আমি বলি ও লিখি- সেটি হচ্ছে পরীক্ষকের পারিশ্রমিক বা সম্মানী। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা এক ধরণের অবহেলা ও গাফিলতি দেখিয়ে থাকেন। মুলতঃ এ ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা উচিত। এ ক্ষেত্রে দু’টো বিষয় লক্ষণীয়। এক. পারিশ্রমিকের স্বল্পতা। দুই. এটি সময়মত পরিশোধ না করা।

এ দু’টো বিষয়ে আমাদের আরেকটু মনযোগ দেয়া অপরিহার্য। পরীক্ষকের পারিশ্রমিক বাড়িয়ে তাদের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। আর পারিশ্রমিক কিংবা সম্মানী যেটি বলিনা কেন-তা পরিশোধে কাল বিলম্ব করা অনুচিত। খাতা দেখার এক বছর পর এর পারিশ্রমিক দেয়াটা কেমন বিষয়? সাথে সাথে হাতে হাতে দিয়ে দিতে আপত্তি কোথায়? শিক্ষা বোর্ডগুলো এ বাবদ টাকা পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে দু’ তিন মাস আগে নিয়ে নেয়। তাহলে পরীক্ষকদের ভাতা পরিশোধে এত বিলম্ব কেন? অনেক পরীক্ষক খাতা দেখার কয়েক মাস পর থেকে মাঝে মাঝে প্রধান পরীক্ষককে ফোন দিয়ে তাদের ভাতার বিষয়ে খোঁজ নেন। কিন্তু, প্রধান পরীক্ষকগণ কোন সদুত্তর দিতে পারেন না।  এখানে তাদের করণীয়ই বা কী আছে? তাদের ও তো একই দশা।

সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব মহানবী (সঃ) শ্রমিকের পাওনা মিটিয়ে দেবার জন্য তাগিদ দেন এভাবে- ‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকাবার আগে তার পারিশ্রমিক মিটিয়ে দেয়া উচিত।’ এ বিষয়ে অপরাপর ধর্মের তাগিদ ও সমান।

এ ক্ষেত্রে পরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষকগণের পারিশ্রমিক প্রদানে শিক্ষা বোর্ডগুলো ধর্মীয় তাগিদের ধারে পাশে ও নেই। অধিকন্তু, তারা এক-দু’ মাস নয় বরং প্রায় এক বছর পর পরিশোধ করে কেবল শিক্ষকদের মর্যাদার অপমান করে না, তাদের ন্যায়ত পাওনা থেকে অহেতুক বছর খানেক সময় বঞ্চিত করে রাখে। ফলে বহু শিক্ষক বোর্ডের খাতা দেখার বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে বসেন। এই একটিমাত্র কারণে অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক পরীক্ষার খাতা দেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন।

পঞ্চমত: আরেকটি বিষয়ে আলোকপাত করা একান্ত অপরিহার্য। সেটি হলো-বোর্ড অফিসে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে পরীক্ষকদের খাতা গ্রহণ করার দুর্ভোগ। একেকটি শিক্ষাবোর্ডের আওতায় কয়েকটি জেলা থাকে। তাই, বোর্ড অফিস থেকে উত্তরপত্র নিতে দুর-দুরান্ত থেকে এসে অনেক শিক্ষক নানা ভাবে হয়রানীর শিকার হন। এ আরেকটি কারণে অনেক শিক্ষক বোর্ডের খাতা দেখতে অনাগ্রহী।  এক্ষেত্রে বিকল্প চিন্তা করা যায়। পরীক্ষার খাতাগুলো ডাক মারফত পরীক্ষকগণের ঠিকানায় পাঠানো যায় কীনা-সেটুকু ভেবে দেখা যেতে পারে। এখন তো আমাদের ডাক বিভাগের তেমন কোন কাজ নেই। তারা যত্ন সহকারে সতর্কতার সাথে খাতাগুলো পরীক্ষকদের নিরাপদে পৌঁছিয়ে দিতে পারে। এতে পরীক্ষকগণ অযথা হয়রানী থেকে বেঁচে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার খাতা এভাবেই পরীক্ষকদের কাছে পাঠানো হয় বলে জানি।

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036430358886719