খেলার মাঠ কমছে, বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা - দৈনিকশিক্ষা

খেলার মাঠ কমছে, বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা

তানজিনুল হক মোল্লা |

শুরুটা নিজেকে দিয়েই করা যাক। কৈশোরে কখনও স্কুল ফাঁকি দেইনি, তবে দুষ্টুমি করতে দ্বিধাবোধ করিনি। তাই মা-বাবার হাতে মারও খেয়েছি অগণিতবার। খেলার প্রতি দারুণ ঝোঁক থাকায় প্রতিনিয়তই সত্য আড়াল করতে হয়েছে। যেমন- ফিজিক্স স্যারের কাছে পড়তে যাওয়ার কথা বলে নারায়ণগঞ্জে ক্রিকেট খেলতে চলে যাওয়া। একদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি, মা-বাবা দু’জনেই অফিসে গেছেন, আর এ সুযোগে আমি নতুন মশারি নিয়ে মাছ ধরতে চলে গেলাম। ম্যাকগাইভার হতে চেয়েছিলাম সেই ছোটবেলা থেকেই। তাই বাবার পাকিস্তান আমলের সেই ক্যামেরাটা ভেঙে চুম্বক বের করতেও দ্বিধাবোধ করিনি।

ঘুড়ি ওড়ানো, ঘুড়ির পেছনে দৌড়ানো, নাটাই বানানো, ডাবগাছের ডালা দিয়ে ক্রিকেট ব্যাট বানানো, পরীক্ষা শেষ হলে সারা রাত ব্যাডমিন্টন খেলা, মার্বেল খেলা, সারা দিন পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি করে চোখ লাল করা, পাখি শিকার করার জন্য গুলতি বানানো, আরও কত কিছুই না করেছি। মাঠের অভাব বোধ করিনি কখনোই। বিকাল হওয়া মাত্রই মাঠে দৌড়। বিকালে ঘুমাতে হবে, স্যার আসবেন, পড়তে বসতে হবে শুনলেই মনে হতো কবে আরও বড় হবো, যেখানে কোনো শাসন থাকবে না।

একসময় মনে হতো আমাদের গ্রামে এমন কোনো স্থান নেই যেখানে আমার পা পড়েনি। আর এখন একটি খেলার মাঠও অবশিষ্ট নেই আমাদের গ্রামে। নগরায়ণের ফলে নাগরিক হচ্ছি ঠিকই, তবে সুনাগরিক হচ্ছি কিনা সন্দেহ আছে। কৈশোরকালটি প্রত্যেককেই কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে পার হতে হয়। এ বয়সে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহও থাকে প্রচণ্ড। ফলে আগ্রহ অনুযায়ী ছেলে-মেয়েরা খেলার জন্য খেলার মাঠ পাচ্ছে কিনা, তা আমাদের সমাজ ও অভিভাবকদের জানা জরুরি।

বর্তমান সময়ে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের অল্প বয়স থেকেই একটা যান্ত্রিক রুটিনের মধ্যে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করেন। কারণ তারা মনে করেন, বেশি বন্ধুর সঙ্গে চলাফেরা করলে বখে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। ফলে সন্তানদের বাইরে যেতে কম দেয়া হয়। অন্যদিকে খেলার মাঠ দখল করে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ ও শিল্পকারখানা তৈরি করা হচ্ছে মফস্বল শহরগুলোতে। কৈশোর সময়ে একমাত্র বিনোদনের স্থান হল খেলার মাঠ। এই মাঠগুলো দিন দিন প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে। বর্তমান সমাজে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে খেলার মাঠের স্বল্পতা অন্যতম। এর জন্য সমাজব্যবস্থা এবং মফস্বল শহরগুলোর অপরিণত পরিকল্পনাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এই অপরিণত পরিকল্পনায় একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী সুবিধা পেয়ে থাকলেও তা নিকটবর্তী প্রজন্মের জন্য বিপদাশংকাপূর্ণ।

আজ থেকে ১০-১৫ বছর পেছনে তাকালেই একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য ধারণা পাওয়া যাবে। বিগত বছরগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বসতবাড়ি। ফলে পতিত জমিগুলো আর ফাঁকা পড়ে না থাকায় ছেলে-মেয়েরা তাদের নিজ নিজ এলাকার স্কুল বা কলেজের মাঠে খেলাধুলা করতে পারছে না। বর্তমানে মফস্বল শহরের স্কুল কিংবা কলেজের মাঠগুলো রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় অথবা নৈশ শিক্ষা ব্যবস্থা অধিকাংশ স্কুলে চালু হওয়ার ফলে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেইসঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের বিকালের সময়গুলো অতিবাহিত করছে। ফলে শারীরিক ও মানসিক দু’ভাবেই তারা বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

একসময় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারও ছেলেমেয়েদের একঘেয়ে ও বিরক্তিকর মনে হয়। তখন তারা চায় নতুন বা চমকপ্রদ কোনো বিষয়ের মাধ্যমে আনন্দ পেতে। যেমন- দলবেঁধে সিগারেট খওয়া, শিক্ষককে ফাঁকি দিয়ে পাঠশালা পলায়ন, পিকনিক বা সিনেমা দেখা, রাতের অন্ধকারে প্রতিবেশীর বাগানের ফল চুরি করা ইত্যাদি কাজে তাদের আগ্রহ ও নিষ্ঠা লক্ষ্য করা যায়।

এবার বলছি খেলার মাঠ ও অপরাধপ্রবণতা কীভাবে সম্পর্কযুক্ত। বর্তমানে খেলার মাঠ কমে যাওয়ার কারণে ছেলেমেয়েরা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। যার ফলে তাদের আচরণগত পরিবর্তন হচ্ছে। ইচ্ছাকৃতভাবে স্কুল পালাচ্ছে। কিংবা সেখানকার নিয়মশৃংখলা ভঙ্গ করছে। এমনকি রাষ্ট্রিক আইন বা পৌর বিধিবহির্ভূত কাজ করছে। মাতা-পিতা বা অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ছেলেমেয়েরা পর্নোগ্রাফি বা মাদকে আসক্ত হচ্ছে দিন দিন। কৈশোরে যে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, খেলাধুলা, গান-বাজনা, অভিনয়, অংকন, কবিতা লেখা এবং অন্যান্য কাজের মাধ্যমে বিকাশ ঘটার কথা, তারা অপরাধমুখী হয়ে উঠছে। তারা চুরি, খুন, আত্মহত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, পকেটমার, মাদক সেবন, ইভটিজিংসহ এমন সব রোমহর্ষক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে যা অকল্পনীয়।

জাতির ভবিষ্যৎ অগ্রগতি নির্ভর করছে কিশোর-কিশোরীদের ওপর। এরাই আগামী দিনে দেশের নেতৃত্ব দেবে, হবে জাতির কর্ণধার। তাই কিশোর-কিশোরীদের অধ্যয়ন, সৃজনশীলতা, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করা জরুরি। প্রতিটি স্কুলে মাঠ থাকার পাশাপাশি সেখানকার পরিবেশ হওয়া দরকার আনন্দময় ও প্রণোদনাপূর্ণ। তবেই জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হবে আমাদের নতুন প্রজন্ম।

তানজিনুল হক মোল্লা : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

সূত্র: যুগান্তর

রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035569667816162