গুণগত শিক্ষা অর্জনে স্বদেশপ্রেম - দৈনিকশিক্ষা

গুণগত শিক্ষা অর্জনে স্বদেশপ্রেম

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন |

নোবেল বিজয়ী নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘শিক্ষা সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র যা দিয়ে বিশ্বের যে কোনো দেশের যে কোনো অবস্থার পরিবর্তন আনা যায়। একজন প্রকৃত ও আদর্শ নেতাকে অবশ্যই নিজ দেশের জন্য স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নিজের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’ কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘সংখ্যায় আপনি কত কম, সেটা কোনো বিষয় নয়, যদি আপনার বিশ্বাস ও দেশপ্রেমের জোর থাকে তাহলে আপনি দেশের ও মানুষের জন্য অনেক কিছুই করতে পারবেন।’

জন্মভূমির মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাই স্বদেশপ্রেম যা শিক্ষাজীবন থেকে শুরু হয়ে আজন্ম লালিত হয়। স্বদেশ প্রেমের বৈশিষ্ট্য হলো আত্মত্যাগ, বীরত্ব, সরলতা, শর্তহীনতা, কৃতজ্ঞতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং একাত্ববোধ। দেশ ও জাতির প্রতি গভীর মমত্ববোধ শিক্ষা জীবনেই জাগিয়ে তুলতে হয় এবং দেশের প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদেরকেই এগিয়ে আসতে হয়। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্কুল জীবন থেকেই দেশের ও সাধারণ মানুষের জন্য সংগ্রামে অবর্তীণ হয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নকালে অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর ডাকে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে দেশপ্রেমিক বাঙালিজাতি পাকিস্তানি শাসন-শোষণ, নির্যাতন ও পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির লক্ষ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতা অর্জন করে। বাংলার মাটি থেকে পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বহুবার বহুবছর কারাবরণ করেন। স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য এদেশের ত্রিশ লাখ মানুষ তাঁদের জীবন, দুই লাখ মা-বোন তাঁদের সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রোথিত হয় লাল সবুজের বাংলাদেশ। আমরা পাই স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র, একটি পতাকা এবং একটি ভূখণ্ড। 

স্বদেশপ্রেম দেশ ও জাতির অগ্রগতির লক্ষ্যে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।  স্বদেশের মাটি থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করতে গিয়ে তিতুমীর হাসিমুখে তার বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। স্বাধীকার আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা ক্ষুদিরাম ও মাস্টারদা সূর্যসেন ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেছিলেন, নজরুল কারাগারের শিকল ভাঙার গান গেয়ে জেল খেটেছেন। তাছাড়া রানা প্রতাপ, শিবাজী, প্রফুল্ল চাকী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, চিত্তরঞ্জন দাশ, রামপ্রসাদ, মদনলাল প্রমুখ দেশপ্রেমিক নিজেদের জীবনের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যেসব বাঙালি অসামান্য অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, যতীন্দ্রনাথ দাস প্রমুখ চিরদিন আমাদের প্রেরণা হয়ে থাকবেন। বিশ্বে বহু রাষ্ট্রনায়ক দেশ ও জাতিকে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। যেমন- ইতালির গ্যারিবাল্ডি, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, রাশিয়ার লেনিন ও স্টালিন, চীনের মাও সেতুং, ভিয়েতনামের হো. চি. মিন, তুরস্কের মোস্তফা কামাল পাশা, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, মালয়েশিয়ার টুংকু আব্দুর রহমান। 

প্রাত্যহিক জীবনের অনেক বিষয়ই দেশপ্রেমের নিদর্শন হিসেবে কাজ করে। যেমন- বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, জাতীয় সংগীত,  জাতীয় পতাকা, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি। আমাদের দেশের দামাল ছেলেরা যখন বিদেশে কিংবা দেশে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে জয়লাভ করে তখন আমরা খুশিতে উদ্বেলিত হই, আর পরাজিত হলে শোকে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ি। এসব দেশপ্রেমের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। একটি মানুষ নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে জম্মগ্রহণ করে সকল উপাদান স্বদেশ থেকে পায় বিধায় স্বদেশের প্রতি মানুষের প্রবল মমত্ববোধ সৃষ্টি হয়। এ জন্য মানুষ স্বদেশের গৌরবে গৌরবান্বিত হয় এবং স্বদেশের অপমানে অপমাণিত হয়। তাই তারা স্বদেশের স্বাধীনতা ও মান-মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে। 

দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মত্যাগকারী ব্যক্তিই বিশ্ববরেণ্য এবং সকলের কাছে পরম পূজনীয়। দেশের শিল্প সাহিত্য, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতির ক্ষেত্রে অবদান রাখা দেশপ্রেমের অংশ। জগদীস চন্দ্র বসু, সাকিব আল হাসান, ড. মুহাম্মদ ইউনুস, রানী হামিদ, নেয়াজ মোর্শেদ, এফ. আর. খান প্রমুখের গৌরবময় অবদান বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। স্বদেশপ্রেমের মাধ্যমে বিশ্বভ্রাতৃত্ব, মৈত্রী ও বিশ্বমানবতা উচ্চকিত হয়ে ওঠে। মানবতার ধর্মে বিশ্বাসী রবিঠাকুর ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে জালিয়ানওয়ালাবাগে ইংরেজদের নির্মম হত্যালীলার প্রতিবাদে ইংরেজ প্রদত্ত “নাইট” উপাধি ত্যাগ করেন। কবি সমুদ্রগুপ্ত বলেছেন, ‘যে নিজের দেশকে ভালবাসে সে বিশ্বপ্রেমিক, মানব-প্রেমিক মানবতাবাদী। স্বদেশপ্রেমের সঙ্গে বিশ্বমৈত্রীর গভীর যোগসূত্র আছে বলেই রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়র, আইনস্টাইন কেবল নিজ দেশের নন, তাঁরা সমগ্র মানব জাতির সম্পদ। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর অমর বাণী ‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।’ বিশ্বনবী কাফেরদের নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন, ষড়যন্ত্র এবং স্বজাতি কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরতকালে বারবার মক্কার দিকে ফিরে তাকান, আর কাতর কণ্ঠে আফসোস করে বলেন, ‘হে আমার স্বদেশ! তুমি কতই না সুন্দর! আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার আপন গোত্রের লোকেরা যদি ষড়যন্ত্র না করত, আমি কখনও তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ প্রতিটি মানুষ জন্ম নেয় পৃথিবীর একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে যার সঙ্গে গড়ে ওঠে তার নাড়ির সম্পর্ক। স্বদেশের জন্য তার মনে জন্ম নেয় নিবিড় ভালোবাসা। তাই মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ থাকলেও নাড়ির টানে দেশে ফিরে আসেন এবং নিজ ভাষায় দেশ ও মানুষের জন্য সাহিত্য রচনা করেন। মা, মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার প্রতি মানুষের যে চিরায়ত গভীর ভালোবাসা তারই বিশেষ আবেগময় প্রকাশ ঘটে স্বদেশপ্রেমের মাধ্যমে। এই স্বদেশপ্রেম কবি জীবনানন্দের অন্তরে সঞ্চার করেছিল আবেগের যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এভাবে, ‘বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’

পৃথিবীর সকল ধর্মে দেশপ্রেমকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক তাঁদের কবিতা, কাব্য, নাটক, গান, উপন্যাস লেখনির মাধ্যমে তাঁদের দেশপ্রেমকে ফুটিয়ে তুলেছেন। নীলদর্পণ, আনন্দমঠ, মেঘনাদ বধ প্রভৃতি গ্রন্থে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে। এছাড়া বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের সাহিত্য কর্মে দেশপ্রেম ও মাতৃভূমির প্রতি অনুরাগ ফুটে উঠেছে। 

জ্ঞানী-গুণীরা দেশপ্রেম সম্পর্কে অনেক সুচিন্তিত মন্তব্য করে গেছেন। প্রাচীন রোমান কবি ভার্জিল বলেছেন, ‘সে-ই সবচেয়ে সুখী, যে নিজের দেশকে স্বর্গের মতো ভালোবাসে।’ প্রাচীন রোমান বাগ্মী সেনেকা বলেছেন, ‘কেউই তার দেশকে তার আকার ও বৈশিষ্ট্যের জন্য ভালোবাসে না, ভালোবাসে কারণ দেশটা তার নিজের।’ প্রখ্যাত আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ বলেছেন, ‘দেশপ্রেম হচ্ছে আপনার দৃঢ় প্রত্যয় যে, আপনার দেশটা অন্যান্য দেশের চেয়ে উৎকৃষ্টতর। কেননা, আপনি ওখানেই জন্মগ্রহণ করেছেন।’ বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে জন এফ কেনেডি যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হন, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আপনার দেশ আপনার জন্য কী করতে পারে সে প্রশ্ন করবেন না, প্রশ্ন করুন আপনি দেশের জন্য কী করতে পারেন।’ 

জাতি হিসেবে ইংরেজদের দেশপ্রেম ছিল ঈর্ষণীয়। একসময় যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, সেটা হয়েছিল ইংরেজদের দেশপ্রেমের কারণেই। উল্লেখ্য, দিল্লির মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আত্মজা জাহানারার স্নেহভাজন এক বাঁদির বসনে হঠাৎ একদিন আগুন লেগে গেলে সেটা নেভাতে গিয়ে জাহানারা স্বয়ং মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন। দেশীয় সব হেকিম-কবিরাজ ব্যর্থ হলে সুরাটের ইংরেজ কুঠিরের চিকিৎসক গ্যাব্রিয়েল বাউটন চিকিৎসা করে তাঁকে সুস্থ করে তোলেন। সম্রাট খুশি হয়ে মি. বাউটনকে তাঁর ইচ্ছানুরূপ পুরস্কৃত করতে চাইলে তিনি নিজের জন্য কিছু না চেয়ে কলকাতার কাছে ইংরেজদের কুঠি নির্মাণের জন্য একখণ্ড জমি এবং ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার চাইলেন। প্রার্থনা মঞ্জুর করা হলো; উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অঙ্কুরোদ্গম হলো। 

একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের নতুন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সকল পশ্চাৎপদতাকে পেছনে ফেলে শৌর্য-বীর্য-সমৃদ্ধিতে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার। এজন্য আমাদেরকে দেশ গঠনের কাজে স্বদেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই দেশ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারায় অগ্রসর হতে পারবে। একাত্তরে যে ফুলটিকে বাঁচানোর জন্য ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছিল, অগণিত মা বোন ইজ্জত দিয়েছিল সেই ফুলটিকে আমরা সবাই মিলে সুন্দর, সতেজ আর সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখব। জঙ্গীবাদ ও মাদকাসক্তরা আমাদেরই স্বজন তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনব। আমাদের সম্পদের সদ্ব্যবহার করে প্রিয় সবুজ শ্যামল দেশটিকে নিয়ে যাব উন্নত দেশের কাতারে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ রেখে যাবো আমরা। এই হোক আমাদের সকলের হৃদয়ের প্রত্যাশা ও দৃঢ় অঙ্গীকার।

লেখক : পরিচালক (গবেষণা ও তথ্যায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম)।

স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0086629390716553