গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার দুর্দশা প্রতিকার দরকার এক্ষুনি - দৈনিকশিক্ষা

গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার দুর্দশা প্রতিকার দরকার এক্ষুনি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শিক্ষা নিয়ে কিছু বলা বা লেখা শিক্ষাবিদদেরই সাজে। আমি শিক্ষাবিদ নই, তবু নিতান্ত বাধ্য হয়েই এ লেখা। আমার জন্ম নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার যে গ্রামে, সেখানে এককালে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। দীর্ঘকাল ধরে অনেকের অনেক চেষ্টায় সেই হোসেননগর গ্রামে হাঁটি হাঁটি পা পা করে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অনেক ধরনা, অনেক চেষ্টায় সেটি এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কয়েক বছর আগে গ্রামের এক কৃতী ব্যবসায়ী, যিনি একই সঙ্গে উচ্চশিক্ষিত এবং এককালে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন, তাঁর প্রয়াস ও অর্থানুকূল্যে গ্রামে একটি কলেজও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাঝে যে শূন্যস্থানটুকু ছিল সেটা পূরণে আমরা এগিয়ে এসেছিলাম। পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত জমির সঙ্গে অনেক শুভানুধ্যায়ীর আর্থিক সহায়তায় তিন বছর আগে হোসেননগর পাইলট স্কুল নামে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্কুলটি একটু ব্যতিক্রমী, এক কক্ষে ছাত্রসংখ্যা ৩৫ থেকে ৪০ জনের বেশি নয়, ফলও ভালো। প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লেখাপড়ার জন্য গ্রামের ছেলে-মেয়েদের এখন আর বাইরে যেতে হয় না। একটি কিন্ডারগার্টেনও আছে এই গ্রামে।  বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা জানা।

নিবন্ধে আরও জানা যায়,  হোসেননগর গ্রাম এবং আশপাশের তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দুটি কিন্ডারগার্টেন থেকে ছেলে-মেয়েরা পড়তে আসে এই হাই স্কুলে। এই জানুয়ারিতে ষষ্ঠ শ্রেণির দুটি শাখায় ৭০ জন ছেলে-মেয়ে ভর্তি হয়েছে। এরা সবাই কেন্দ্রীয়ভাবে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় পাস করে এসেছে। ভর্তির কয়েক দিন পর এদের কার কী অবস্থা বোঝার জন্য পঞ্চম শ্রেণির পাঠক্রমের ওপর খুব সহজ একটা পরীক্ষা নেওয়া হয়। উদ্দেশ্য, যার যা দুর্বলতা আছে সেসব শনাক্ত করে তা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করা। চাঞ্চল্যকর তথ্য ওঠে আসে এই পরীক্ষায়। ৭০ জনের মধ্যে ২০ জন ভালোমতো বাংলা পড়তেই পারে না! চেষ্টা করেও ইংরেজি পড়তে পারে না অর্ধেকের বেশি। তাদের মধ্যে অর্ধেক আবার ইংরেজি বর্ণমালাই পুরোটা চেনে না। অঙ্কের অবস্থাও তথৈবচ। খোঁজ নিয়ে জানলাম শুধু এখানেই নয়, বেশির ভাগ বিদ্যালয়েই একই অবস্থা।

শিশুদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে বিপুল সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। প্রায় সব শিশুই এখন স্কুলে যায়। তাদের প্রায় সবাই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে, সমাপনী পরীক্ষায় পাস করে বেরিয়ে আসে। জিপিএ ৫-এর বিপুল সংখ্যা আর ‘শিক্ষিতের’ হারের শতকরা হিসাব নিয়ে আমরা আত্মতৃপ্তিতে নিমজ্জিত। কিন্তু এরা কী শিখে বেরিয়ে আসছে তা নিয়ে আমাদের কোনো গভীর চিন্তা আছে—এমন কোনো লক্ষণ দেখতে পাই না। হোসেননগর পাইলট স্কুলের সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত বাচ্চাদের নিয়ে অতিরিক্ত সময়ে বসছেন শিক্ষকরা। শুরু করেছেন প্রথম শ্রেণির বই দিয়ে। আশা করছি আগামী ছয় মাসে এরা বাংলা পড়তে পারবে, ইংরেজি বর্ণমালাটাও হয়তো অনেকটা রপ্ত করতে পারবে।

কিন্তু এমনটি তো হওয়ার কথা নয়। পাঁচ বছর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পর একটি বাচ্চা কেন পড়তে পারবে না বা সাধারণ যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করতে পারবে না? অথচ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞদের দ্বারা একটি চমৎকার এবং বিশদ পাঠক্রম তৈরি করা হয়েছে, যাতে একেক দিন তাদের কী পড়াতে হবে তারও বিস্তারিত নির্দেশনা রয়েছে। এই পাঠক্রম অনুযায়ী যদি সত্যিই পড়ানো হতো, তাহলে একটি বাচ্চারও এ অবস্থা হওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ চমৎকার পাঠক্রমটি কাগজেই রয়ে গেছে, গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে তার বাস্তব প্রয়োগ হয়নি।

আরো একটি তথ্য উঠে এসেছে এই পরীক্ষায়। দুটি কিন্ডারগার্টেন থেকে যে ছেলে-মেয়েরা এসেছে, তাদের মাঝে এমন চরম দুর্দশাগ্রস্ত নেই কেউ। অথচ পাকা ভবন এবং মোটামুটি ভালো বেতনের শিক্ষকসমৃদ্ধ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর তুলনায় এই কিন্ডারগার্টেনগুলোর অবকাঠামোগত অবস্থা অনেক মলিন। বেড়ার ঘরে অত্যন্ত স্বল্প বেতনে কয়েকজন শিক্ষক তাদের পড়াচ্ছেন। চাকরির নিশ্চয়তাও নেই তাঁদের, তাঁরা জানেন যে ছেলে-মেয়েরা যদি লেখাপড়া না শেখে তাহলে তাঁদের চাকরি থাকবে না। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম অনেক কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠছে গ্রামে গ্রামে। এটা তো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিকল্প হতে পারে না।

বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্তে আসতে হচ্ছে যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা তাঁদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। বিদ্যালয়গুলোর ভৌত অবস্থার উন্নতি হয়েছে, শিক্ষকদের বেতন যৌক্তিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে; কিন্তু মূল কাজটি হচ্ছে না। তাঁরা সরকারি কর্মচারী, তাঁরা জানেন তাঁদের চাকরি হারানোর ভয় নেই। তাঁদের অনেকের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তবে সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ, সম্ভবত তাঁদের একটি বড় অংশের কমিটমেন্ট। সরকারও তাঁদের দিয়ে পড়ানোর বাইরে অনেক কাজ করিয়ে নিচ্ছে। ফলাফল, প্রায় কিছুই না শিখে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করছে বিপুলসংখ্যক শিশু।

মাঝপথে বাচ্চাদের ঝরে পড়া কী করে ঠেকানো যায় তা নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। আমার মনে হয়, ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ আদৌ পড়তে না পারা। যে বাচ্চাটি বাংলা বই পড়তে শেখেনি, বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ তার কাছে আকর্ষণীয় মনে হবে কী করে? আর এমন নিরানন্দ একটি স্থানে যেতে তার আগ্রহই বা থাকবে কেন।

শিক্ষকদের যোগ্যতা বা কমিটমেন্টের ক্ষেত্রে হঠাৎ কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। এ পরিস্থিতির নিরসনে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে কী করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করুন শিক্ষাবিদরা। সাদা চোখে যে কটি বিষয় দৃষ্টিগোচর হচ্ছে তা শুধু নিচে উল্লেখ করছি।

১. প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার বিপুল কর্মযজ্ঞ সম্পূর্ণ অর্থহীন। কিছু না জেনে এ পরীক্ষায় পাস করা যায়। বরং জীবনের শুরুতেই অসদুপায় অবলম্বনের একটা মহড়া দেখছে শিশুরা। বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আছে যে শিক্ষকরা পরীক্ষার হলে এই শিশুদের ‘সাহায্য’ করেন। আর যাই লিখুক না কেন, নম্বর দিয়ে দেওয়ার উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ তো আছেই। শিশুদের ওপর এই অপ্রয়োজনীয় অত্যাচার এক্ষুনি বন্ধ হোক।

২. তৃতীয় শ্রেণি থেকে অনেক বিষয়ে অনেক বই পড়ানো হচ্ছে বাচ্চাদের। সঠিক পরিবেশে, সঠিক তত্ত্বাবধানে তাদের উন্নয়নে তা সহায়ক হচ্ছে। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর বাস্তবতায় এসবের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রস্তাব রাখছি, প্রথম শ্রেণিতে পুরো এক বছর তাদের শুধু বাংলা পড়তে শেখানো হোক, আর ১০০ পর্যন্ত সংখ্যা। তবে এটুকু যেন অবশ্যই শেখানো হয় তা নিশ্চিতকল্পে যথাযথ নজরদারির ব্যবস্থা করা হোক। দ্বিতীয় শ্রেণিতে সেই সঙ্গে শুধু ইংরেজি বর্ণমালা, সহজ কিছু শব্দ ও বাক্য। তৃতীয় শ্রেণিতে জোর দেওয়া হোক সে যেন স্বচ্ছন্দে যেকোনো বাংলা বই এবং সহজ ইংরেজি পড়তে পারে, আর সেই সঙ্গে সাধারণ যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ।

৩. এটুকু যদি করা যায়, তবে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে যে ছয়টি বিষয় পড়ানো হয় তা পড়ানো যেতেই পারে। কারণ এখন সে পড়তে পারে। আর যেহেতু সে পড়তে পারে, আকর্ষণীয় যেকোনো কিছু দিলেই সে পড়তে আগ্রহী হবে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে তাকে আর প্রথম শ্রেণির বই হাতে পেলে বিব্রত হতে হবে না।

একটি শিশুর শেখার ক্ষমতা অসীম। প্রয়োজন শুধু তাকে যথাযথ ‘টুল’ দিয়ে শিখতে সক্ষম করে তোলা। এই সক্ষমতা তার অধিকার। তার এই অধিকারকে শ্রদ্ধা করা, রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।

লেখক : মো. তৌহিদ হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব

নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033249855041504