এখানে এক বছর চাকরি করে কেউ যদি ঢাকায় ফ্ল্যাট ও কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালান্স করতে না পারে তাহলে তো সে কোনো উপযুক্ত শিক্ষা ক্যাডারই না! এমনটাই চাউর রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) শিক্ষা পরিদর্শক ও সহকারি শিক্ষা পরিদর্শক হিসেবে বদলিভিত্তিক পদায়ন পাওয়া বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে। এমন ‘ঐতিহ্য’ ধরে রাখতে ডিআইএর একজন পরিদর্শক উপরির টাকা গুণতে বেকার স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। আরেকজন গেছেন শাশুড়ীকে নিয়ে। আরেক নারী কর্মকর্তা তার ভুয়া সাংবাদিক স্বামীর দাপট দেখিয়ে গত পাঁচ বছর ঢাকার বাইরের এক সরকারি কলেজের সবাইকে তটস্থ রেখে ৫ আগস্টের পর নতুন পরিচয়ে ডিআইএতে বদলি হয়ে এসেছেন। আবার কোথাও একসঙ্গে তদন্তে যাওয়া দুই নারী কর্মকর্তা ঢাকায় ফিরে ঘুষের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে অস্থির করেছেন শিক্ষা ভবনে ডিআইএর অফিসের কক্ষ।
নাম না প্রকাশের শর্তে শেরপুর অঞ্চলের একজন শিক্ষক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাকে আমরা দুর্গন্ধ জারিফ (ছদ্মনাম) বলে চিনতাম। গত ২০ বছর ধরে যাকে আমরা বেকার ও প্রায় ভবঘুরে জেনে এসেছি সেই জারিফই এবার দেখি আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অথচ জারিফ পুরোই বেকার অদ্যাবধি। জানা গেলো জারিফ এসেছেন তার কর্মকর্তা স্ত্রীর সঙ্গী হিসেবে। টাকা গুণতে আর ঘুষ চাওয়ার দায়ে সম্ভাব্য ‘গণধোলাই থেকে রক্ষা করতে’। রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে সুবিধা নিতে।
তবে, অভিযোগ অস্বীকার করছেন সব কর্মকর্তাই। অভিযোগ ওঠার পর গোমর ফাঁস হয়েছে অভিযুক্ত একজনের স্বামীর পেশা সম্পর্কে। এতদিন সহকর্মীদের ঝাড়ি মেরে আসছিলেন এই বলে যে, তার স্বামী অমুক পেশার খুব দাপুটে একজন। তমুক সংগঠনের সদস্য। ঘুষের অভিযোগ ওঠার পর জানা গেলো, স্বামীটি নিছকই একজন ভুয়া কবি ও সাংবাদিক।
এদিকে গত তিন সপ্তাহে তদন্ত ও পরিদর্শন করা তিন জেলার ত্রিশটি প্রতিষ্ঠানের তিন শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী আতংকে দিন কাটাচ্ছেন। ঘুষের টাকা দিয়েও তারা বিপদে। কারণ, তাদেরকে বলা হচ্ছে, টাকা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে দৈনিক শিক্ষাডটকম পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হতে পারে। যদি প্রতিবেদন প্রকাশ হয় তাহলে অভিযোগগুলোর তদন্তেও পাঠানো হবে ডিআইএতে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডারদেরই। ঘুষ দেওয়া এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা শুধু তাদের অভিযুক্ত সহকর্মীদের বিষয়ে তদন্ত কমিটির কাছে বলবেন যে, তারা এক টাকাও ঘুষ দেননি এবং কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেননি।’
যে তিন জেলার ত্রিশ প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
কুষ্টিয়ার দশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : নুরুজ্জামান বিশ্বাস ডিগ্রি কলেজ, দৌলতপুর; ঝাউদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দৌলতপুর; বাহিরমাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দৌলতপুর; আড়িয়া ইউনাইটেড মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দৌলতপুর; বোয়ালিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দৌলতপুর; পিপুলবাড়ীয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দৌলতপুর; কল্যাণপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দৌলতপুর; এসএমএন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দৌলতপুর; শ্রীরামপুর মোজাদ্দেদীয়া দাখিল মাদরাসা, মিরপুর ও সুলতানপুর সিদ্দিকীয়া ফাজিল মাদরাসা, মিরপুর।
শেরপুর সদরের দশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : নিজাম উদ্দিন আহমেদ মডেল কলেজ; শেরপুর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ; কসবা টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট; সুলতানপুর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট; খুনুয়া চরপাড়া মৌলভী নগর উচ্চ বিদ্যালয়; কুমরী কাটাজান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়; আন্ধারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়; আলহাজ্ব বাবর আলী হাইস্কুল ; বয়ড়া পরানপুর দাখিল মাদরাসা ও সন্নাসীর চর ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা।
টাঙ্গাইলের দশ প্রতিষ্ঠান: নরিল্যা মহাবিদ্যালয়, নতুন কহেলা কলেজ, বিবিজি উচ্চ বিদ্যালয়, বানিয়াজান দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়, মমতাজ আলী উচ্চ বিদ্যালয়, পিটিএস উচ্চ বিদ্যালয়, হাজরাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়, চাপাইদ পিরোজপুর এম আই দাখিল মাদ্রাসা, জটাবাড়ী ফাজিল মাদরাসা ও হরিনাতেলী আর এম দাখিল মাদরাসা।
একজন ভুক্তভুগী এমপিওভুক্ত শিক্ষক বলেন, আমার জানামতে এমপিওভুক্ত যেসব প্রতিষ্ঠানে মিনিস্ট্রি অডিট হয়েছে, ঐসব প্রতিষ্ঠানের অগণিত শিক্ষক (বিশেষ করে কম্পিউটার, শরীরচর্চা ও গ্রন্থাগার শিক্ষক) অমানবিক হয়রানি মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির মধ্যে আছেন। অনেকেই ইতোমধ্যে মাউশি অধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও কোর্টে ধর্ণা দিতে দিতে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। দৈনিক শিক্ষাডটকম ও আমাদের বার্তাকে অনুরোধ করবো- সেইসব নির্যাতিত, নিপীড়িত হতভাগ্য শিক্ষকদের খোঁজ নিন, তাদের পাশে দাঁড়ান, তাদের পরিবারগুলেকে রক্ষা করুন। মজলুমদের দোয়া নিশ্চয়ই আপনারা পাবেন।
তিনি আরো বলেন, ঘুষ দিলে নিয়োগ বৈধ, সার্টিফিকেট বৈধ, টাকা না দিলে সবই জাল, সবই ভুয়া। চাকরি নট, সরকারি টাকা ফেরত দাও। এ অনাচার আর কতোদিন চলবে এই দেশে? জাতির কাছে আমার প্রশ্ন- নিয়োগের সময় নিয়োগ বোর্ডে ডিজি'র প্রতিনিধি থাকেন। এমপিও আবেদনের সময়ও ডিজি অফিস কাগজপত্র যাচাই করেই এমপিও ছাড় দেন। তাহলে চাকরি জীবনের মাঝামাঝি বা শেষে এসেও চাকরি "বৈধ নয়" "গ্রহণযোগ্য নয়" "এক মাসের মধ্যে উত্তোলিত সমুদয় টাকা ফেরত দিতে হবে, অন্যথায় মামলা" এমন গজব নিরীহ শিক্ষকদের ওপর নাজিল করানো হয় কীভাবে?
‘অডিট মানেই শিক্ষকদের মাথায় সাত আসমান ভেঙে ঠাডা পড়া। এই ঠাডা সিস্টেম বন্ধ অথবা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত, যোগ করেন তিনি।