তখন মোবাইল আমাদের হাতে আসেনি। গ্রামে থাকতাম সে সময়ে এবং একটি পত্রিকা হাতে পেতেও অনেক সময় লেগে যেতো। আমাদের গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরে একটি বাজারে দু একটি পত্রিকা আসতো। বিকালে বাজারে গিয়ে সিরিয়াল দিয়ে সেই পত্রিকা পড়তে হতো। পত্রিকা পড়ার নেশা ছিল তীব্র। তাই যত কষ্টই হোক পত্রিকা পড়ে বাড়িতে ফিরতাম। প্রতিদিনের মতই বিকালে বাজারে গেলাম পত্রিকা পড়তে। পত্রিকার শিরোনাম দেখে অবাক হয়ে গেলাম। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি বন্ধের দাবিতে ঢাকার রাজপথে হাজার হাজার মানুষের স্লোগান। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এমন স্লোগান খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। কিন্তু নাটকের একটি চরিত্রের শেষ দৃশ্যে ফাঁসি হতে পারে, এমন সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছে এবং ফাঁসি যেন না হয়-সেই দাবি জানাচ্ছেন। এমন নজীর দেশে আর কখনো হয়নি এমনকি বিশ্বেও না। একটি চরিত্রকে নাট্যকার কিভাবে রূপায়ন করলেন যে-হাজার হাজার দর্শকের মনে সেটা রেখাপাত করলো এবং দর্শক প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজপথে নেমে এলো। এমন ঘটনা আর ঘটবে কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে।
একজন লেখকের সার্থকতা ঠিক এখানেই। একজন লেখক যখন চরিত্রায়নে সর্বোচ্চ মুন্সিয়ানা প্রদর্শনে সক্ষম হন, তখনই শুধু এমনটি ঘটতে পারে। প্রাচীন গ্রীসে সোফোক্লেস যখন কিং ইডিপাস রচনা করলেন তখন পাঠক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল নজীরবিহীন। উইলিয়াম সেকশপিয়ার যখন ম্যাকবেথ, ওথেলো এবং কিং লেয়ারের মত চরিত্রগুলিকে সর্বোচ্চ মুন্সিয়ানায় রূপায়ন করলেন তখন তা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলো।জোনাথন সুইফট যখন গালিভারের মত চরিত্র রূপায়ন করলেন তখন সারা বিশ্বে হৈ চৈ পড়ে গেলো। সাহিত্য বোদ্ধাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেলো-সেটা বিশ্লেষণ করতে করতে। আমাদের দেশেও সাহিত্য বোদ্ধাদের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কোন কমতি দেখি না।
হুমায়ূনের লেখনির সাহিত্যমূল্যকে তারা বিশ্বমানের বলতে নারাজ। সাহিত্য সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবেই দেখতে হবে। কিন্তু সেই সমালোচনা হতে হবে গবেষণালব্ধ। ব্যাপক গবেষণা ছাড়া কোন জনপ্রিয় সাহিত্যকর্মকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা হয়নি বললেই চলে। কিছু খন্ডিত ও বিচ্ছিন্ন সমালোচনা পাওয়া যায় তার লেখনিকে ঘিরে। আর খন্ডিত সমালোচনা দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য ও শৈল্পিক মূল্য কতটুকু যাচাই করা সম্ভব-সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশ্বের বেশিরভাগ খ্যাতিমান লেখকেরা মৃত্যুর পর বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। এদিক থেকে হুমায়ূন আহমেদ অনেক বেশি সৌভাগ্যবান। তিনি তার জীবদ্দশায় তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন এবং মৃত্যুর পরেও সেটা অব্যাহত আছে।
সমালোচকরা বলতেই পারেন যে, হুমায়ূন শুধু তার পাঠক, শ্রোতা আর দর্শকদের বিনোদন দিতেই লিখে গেছেন, লেখার মৌলিকত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে তার মুন্সিয়ানায় ঘাটতি ছিল। কেউ আবার বলতে পারেন, হুমায়নের লেখনীর সাহিত্য গভীরতা কম। কেউ হয়তো বলবেন তার লেখনিকে ক্লাসিক প্যাটার্নে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। আরো অনেক সমালোচনা থাকতে পারে। কিন্তু চরিত্র রূপায়নের ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের মুন্সিয়ানা নিয়ে কোন সমালোচক প্রশ্ন তুলতে পারেন নি। আর চরিত্র রূপায়নের মাস্টার ছিলেন বলেই তিনি আজ এত জনপ্রিয়। জনাথন সুইফটও গালিভারের মত চরিত্র সৃষ্টি করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ঠিক একইভাবে হিমু, মিসির আলী, শুভ্রে মত চরিত্র রূপায়ন করে হুমায়ূন আহমেদ আজ জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছেন। বাকের ভাইকে বাঁচাতে দর্শক শ্রেতাদের যে আবেগের বিস্ফোরন ঘটেছিলো. বিশ্ব সাহিত্যে বা শিল্পে তা ঘটেনি।
হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার কারণ ব্যাখ্যা করা আমার এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়।ফরাসি বিপ্লবের পটভূমি রচনায় জ্যাক রুশোর লেখা '' মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্র সে শৃংঙ্খলিত'' লাইনটি অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলো। একজন লেখকের লেখা একটি দুটি লাইনই সামাজিক কম্পন তৈরি করতে পারে। এমনকি বিশ্ব সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। সক্রেটিসের '' নিজেকে জানো '' উক্তিটি বিশ্ব সভ্যাতার ইমেজকে ধারণ করে। মানুষকে যতই পরাধীন করে রাখা হোক না কেন, সে তার সহজাত স্বাধীনতাকেই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যে স্বাধীনতার কথা বলে গেছেন সক্রেটিস, জ্যাক রুশো, জনাথন সুইফট, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং হুমায়Sন আহমেদ। হিমু চরিত্রটিকে সার্বজনীন করতে পেরেছেন। হিমু তার সহজাত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় এবং অবিচল। স্বাধীনচেতা হিমু শুধু একটি নির্দিষ্ট কালের প্রতিনিধি নয়, সে সর্বকালের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে। কালজয়ী চরিত্রে নিজেকে দাঁড় করাতে পেরেছে। হিমু এমন একটি দর্শন ধারণ করেছে যে ,দর্শন সে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে এবং আর্থ- সামাজিক আর সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। সমাজের তরুণ-কিশোররা কল্পিত চরিত্র হিমুকে অনুসরন করেছে। তার ব্যক্তিত্ব, চাল চলন, কথাবার্তা, পোশাক অনুকরন করেছে। হিমু চরিত্রের স্রষ্টা হুমায়ূনের কৃতিত্ব ঠিক এখানে। নান্দনিকতা ছিল হুমায়ূনের লেখনির প্রাণশক্তি। নান্দনিকতা সেটাকে অমর করে রাখে। মান্না দের কফি হাউজের গানটি নান্দনিকতার জন্যই অমর হয়ে থাকবে। মান্না দে সেই কফি হাউজে যেতেন না, কিন্তু গানটিকে এমন নান্দনিক করে গাইলেন যে শ্রোতারা বিশ্বাস করতে শুরু করলো এটি তার জীবনেরই গল্প। রোমান্টিক সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয়েছিলো-শব্দচয়নকে কেন্দ্র করে।
সাধারন মানুষের ভাষা সহজ। আর তাই সহজ ভাষাতেই হতে হবে সাহিত্যকর্ম। হুমায়ূন সাধারণ পাঠকের মন পড়তে পারতেন। হুমায়ূন তার লেখনিতে সহজ সরল আর প্রাঞ্জল ভাষা ব্যবহার করেছেন ,কিন্তু ভাষার মাধুর্যতার প্রশ্নে তিনি আপস করেননি। লেখার পরতে পরতে যে রস পাঠকেরা পেয়ে থাকেন, সেটা এই মাধুর্যতার কারণেই। হুমায়ূন আহমেদের লেখনিতে বৈচিত্র্য বিদ্যমান। কমেডি এবং ট্রাজেডির যৌক্তিক সমন্বয় করতে তিনি ছিলেন ওস্তাদ। আমরা উইলিয়াম শেকশপিয়ারের নাটকে দেখি। হুমায়ন আহমেদ তার কমিক চরিত্রগুলিকে রোমান্টিক ধাঁচে উপস্থাপনে মাস্টার ছিলেন যা সচারাচর অন্যান্য লেখকের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এ্যারিস্টিটল তার ' পয়েটিকস' এ নাটকের তিনটি ইউনিটির কথা বলেছিলেন, যেটা ক্লাসিক নাটকের অপরিহার্য উপাদান ছিল। হুমায়ূন আহমেদের নাটকে ঠিক এই দিকটা প্রবল ছিল। তিনি নাটকের গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে এসে নাটকের বহুমাত্রিক বিষয়ে প্রাধান্য দিলেন। নাটকের প্লটকে তিনি ভিন্ন ধাঁচে সাজালেন। নাটকের কল্পরূপকে জীবন্ত করে তুলতে লাগলেন। প্রতিটি চরিত্রকে এমনভাবে উপস্থাপন করলেন যেন, কোনটার চেয়ে কোনটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। চরিত্র হিমু, মিসির আলী, শুভ্রসহ আরো যত চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন, তাদের অনন্য বৈশিষ্ট্য হল নিরপেক্ষতা।
হুমায়ূন আহমেদের রচনার আরেকটি অনবদ্য দিক হল, পয়েটিক জাস্টিস। বাস্তবিক ন্যায় বিচার আর কাব্যিক ন্যায় বিচারের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। নাটকীয়তার ধাপে ধাপে পয়েটিক জাস্টিস প্রতিষ্ঠিত হয়। লেখার মাঝে জীবনের বাস্তবতাকে তুলে আনা এবং পাঠককে নতুন করে স্বপ্ন দেখায় তার সাহিত্য। পাঠক ও দর্শকদের মনোজগতে বিচরন করতে পারতেন হুমায়ূন। প্রাণহীনকে প্রাণ দিয়ে উপস্থাপন করতে পারতেন। পাঠকের অনুভূতির জায়গা তার ভাল করে জানা ছিল। পাঠককে কল্পজগতে বিচরন করিয়ে বাস্তবতার স্বাদ গ্রহন করাতে পারতেন।
সাহসী লেখায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। ব্যঙ্গ করতেন উচ্চমার্গের লিখন শৈলীতে-যা পাঠকের হৃদয়ে রসদ জুগাতো। তার ব্যঙ্গ রচনার ধাঁচ দেখে জনাথন সুইফটকেই মনে পড়ে যায়। মোটিভেশন এবং চমক তার উপন্যাস এবং নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার সাহিত্যকর্মের প্রতিটি চরণেই যেন নতুন চমকের আস্বাদন। সাবলীল, ইউনিক এবং ড্রামেটিক সংলাপে তিনি পান্ডিত্য দেখিয়েছেন। সংলাপে হিউমারকে এক অনন্য রূপ দিয়েছেন। ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে চরিত্রের বিশ্লেষণ এক ভিন্ন সংযোজন তার লেখনির। ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনায় অভিনবত্বের সাক্ষর দেখতে পাই। তার শ্যামল ছায়া উপন্যাসে হাসান আলীর রাজাকার থেকে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠার গল্পটি পাঠকদের মুগ্ধ করে, নতুন ভাব জগতে নিয়ে যায়। হুমায়ন আহমেদ ছিলেন আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক লেখক। তার দেয়াল উপন্যাসটিতে অসাম্প্রদায়িকতার চিত্র ফুটে উঠেছে। সাম্প্রদায়িক চেতনা একটি সমাজকে কতটা পিছে ঠেলে দেয় তা তিনি তুলে ধরেছেন তার বিভিন্ন উপন্যাসে। বাঙালি সম্প্রীতির অনন্য নজীর দেখা যায় তার 'জোছনা ও জননীর গল্প' উপন্যাসে। হুমায়ন আহমেদ তার রচনাগুলিতে কাহিনী, সংলাপ, এ্যাকশন এমনভাবে সাজাতেন যেন যে কেউ পড়লে সে ভাবতে শুরু করতো এটা বুঝি তার নিজের জীবনেরই গল্প। কাহিনী-বর্ণনার প্রতিটি পর্বে নাটকীয়তা বিদ্যমান। েনাটকীয়তা পাঠককে শুরুতে সংশয়ী ও নৈরাশ্যবাদী করলেও সমাপ্তিতে পাঠক আশাবাদী হয়েছেন এবং হতাশা নয়, আশাতেই যে জীবনের পূর্ণতা তা উপলব্ধি করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিতর্কিত হয়েছেন, কিন্তু তার লেখনিতে এর একটু আঁচও লাগেনি। আর এখানেই হুমায়ূনের বিশেষত্ব। তিনি ছিলেন একাধারে ওপন্যাসিক, গল্পকার, কবি, গীতিকার, নাট্যকার । তিনি ছিলেন এমনই একজন সৃষ্টিশীল মানুষ, যিনি তরুণ আর কিশোরদের বইমুখী করতে পেরেছিলেন, দর্শকদেরকে নাটকমুখী করতে পেরেছিলেন এবং সুস্থ ধারার বাংলা চলচিত্র নির্মাণ করে মানুষকে সিনেমামুখী করেছিলেন। সুস্থ ধারার বিনোদন দিয়ে বাংলা সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রেম, বিরহ, ট্রাজেডি, কমিডি, ট্রাজিক- কমিডি, রোমান্টিক- কমেডি, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, কবিতা, গান, নাটকসহ নানা বিষয়ে এক ভিন্নমাত্রিক লেখা জাতিকে উপহার দিয়েছেন। বহুব্রীহি, এই সব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমনি, নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগারের মত মৌলিক এবং হৃদয়গ্রাহী লেখা খুব কম লেখকই উপহার দিতে পেরেছেন। জীবনের অনেক ছোট ছোট বিষয়কে কাব্যময় করে তুলতে পারতেন। তার নিজের জীবনের মত। প্রতিটি মানুষের জীবনের গল্প ভিন্ন কিন্তু সবার গল্পগুলি যেন একই সুতায় গাঁথা মালার মত। হুমায়ন আহমেদ ঠিক এই দর্শনটিই বুঝতে পেরেছিলেন।
নিঃঙ্গতা জীবনের একটি বড় অংশ। আর এটিকে হুমায়ূন তার ' তোমাকে' উপন্যাসে দারুনভাবে চিত্রিত করেছেন। মানুষ অর্থবিত্তে স্বচ্ছল হলে বড়লোকিপানা দেখাতে পছন্দ করে। হুমায়ন তার ''নক্ষত্রের রাত'' উপন্যাসে রেবেকার মার চরিত্রের মাধ্যমে। সাধারন মানুষ প্রাণ খুলে হাসতে চায়, গল্প শুনতে চায়, নিজেদের গল্প বলতে চায়। আর সেটিই দশকের পর দশক ধরে করে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, মানুষ তাকেই মনে রাখে, যিনি বাঁক নিতে জানেন, নতুন পথের সন্ধান দিতে পারেন। শ্রোতা, দর্শক আর পাঠককে আকৃষ্ট করতে তাকে ভাঁড়ামি, অশ্লীলতা আর অযথা বাক্য বয়ানের প্রয়োজন হয়নি। চরিত্রায়নের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা, সহমর্মিতা, স্নেহ আর হাস্যরসের মাধ্যমে এক ধরণের বৈচিত্রময় নান্দনিকতা তৈরি করতে পারতেন। " এই সব দিনরাত্রি'' এবং '' আজ রবিবার '' নাটকে তিনি যৌথ পরিবারের বন্ধনকে তুলে ধরেছেন চমৎকারভাবে। ‘কোথাও কেউ নেই, নাটকে এমনটি দেখা গেলো। তিনি নির্জলা সত্যের আড়ম্বরহীন উপস্থাপন করতে পারতেন। নেতিবাচক চরিত্রেও যে ইতিবাচক কিছু দিক থাকে-তা তিনি দেখিয়েছেন কোথাও কেউ নেই নাটকে। মিসির আলী, হিমু, শুভ্র চরিত্র সাদা চোখে হয়তো মূল্যহীন মনে হবে। কিন্তু বাস্তব জীবনে যা করা সহজ নয়, তারা তাই করে দেখিয়েছে। এজন্যই এই চরিত্র সর্বকালের প্রতিরূপ। জীবনঘনিষ্ট বিষয়ের অপূর্ব দৃশ্যায়ন বা চিত্রায়ন করতে পারতেন। তার বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
চরিত্রের রূপায়ন পাঠকের বিষন্ন মনকে ম্যাজিকের মত প্রশান্তি এনে দিয়েছে। তার লেখনি দেশের পর্যটন শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। তার রচিত ‘সমুদ্রবিলাস, উপন্যাসের মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপটি বিশ্ব পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। হুমায়ূন ছিলেন এমনই একজন লেখক যিনি তার লেখনির মাধ্যমে একটি জাতীয় রুচি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সহজাত কাব্যিক প্রকাশ পাঠককে মুগ্ধ করতো। খুব বেশি কবিতা তিনি লেখেননি।
সাহিত্যের মূল স্রোতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হুমায়ূন আহমেদ বলতে গেলে উদাসীন ছিলেন। তার সহজাত এবং স্বভাবজাত গল্প বলার ধরন আর ব্যতিক্রমী লেখনির কারণেই শ্রোতা, দর্শক আর পাঠকেরা তার সৃষ্টিকর্মকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তার সাহিত্য-কর্ম নিয়ে গবেষণা করার জাতীয় দীনতার ছাপ দেখি। তিনি বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে লেখেন-এমন বাচ্য উচ্চারিত হয়েছে। আমার প্রশ্ন হল, যারা বানিজ্য করেননি তাদের লেখা জনগণ লুফে নিল না কেন? হুমায়ূন আহমেদের লেখা কেন জনগণের পছন্দ হল? কি জাদু আর মধু তার লেখায় আছে? যাহোক আমি অতবড় বোদ্ধা নই। যা হোক গতানুগতিক সাহিত্য পাঠ দিয়ে হুমায়ূনকে মূল্যায়ন করা যাবে না। তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং একুশে পদকে ভূষিত হোন। কিন্তু এ দুটি পুরস্কারই তার সৃষ্টিকর্মের জন্য যথেষ্ট নয়। তার সৃষ্টিকর্মকে জাতীয়ভাবে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়নের সময় এসেছে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিএএফ শাহীন কলেজ, ঢাকা