প্রস্তাবিত চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পে জমির মূল্য বেশি দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায়ের অপচেষ্টা হয়েছে। অধিক মূল্য দেখিয়ে প্রথমে জমি কেনা, পরে ওই জমিতে বিশ্ববিদ্যালয় করতে সরকারের কাছে দরখাস্ত করা এবং অধিক মূল্যে জমি কেনা হয়েছে দেখিয়ে ক্ষতিপূরণ দাবি—সামগ্রিক পর্যালোচনায় এটি আইনের সঙ্গে প্রতারণা। ওই প্রকল্পের ক্ষেত্রে জমির দর নিয়ে পৃথক রিটের চূড়ান্ত শুনানিতে এসব কথা বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে গতকাল বুধবার রিটের ওপর শুনানি হয়।
শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন বলেন, কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে, সেখানে একটি ভবনের নকশার অনুমোদন নেওয়া হয় ২০১৮ সালে। অথচ ২০১৯ সালে জমি কেনা হয়। আর যেদিন দরখাস্ত করা হয়, কথিত মতে সেদিনই নকশা অনুমোদন হয়। আবার নকশা প্রস্তুতের তারিখও ভিন্ন, এতে প্রতীয়মান হয়, এসব ভুয়া কাগজপত্র এবং জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্ট।
উল্লেখ্য, প্রস্তাবিত চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে কারসাজির চেষ্টা নিয়ে গত ২৭ জানুয়ারি একটি দৈনিকে ‘চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়: মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠদের দুর্নীতির জাল’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া আইন মন্ত্রিসভা চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করে ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বরে। আর জাতীয় সংসদে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাস হয় ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়া হয় ২০২১ সালের ৬ এপ্রিল।
অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন গতকাল শুনানিতে বলেন, একটি ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, রিট আবেদনকারী সেলিম খানের (চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান) সন্তানেরা সেখানে প্রতি শতাংশ জমি ৯৮ হাজার টাকায় কিনেছেন। এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেখা গেছে প্রতি শতাংশ জমি ২ লাখ টাকায় কিনেছেন তাঁরা। কাছাকাছি সময়ে আরেকজন রিট আবেদনকারী প্রতি শতাংশ জমি কিনেছেন ৩ লাখ টাকায়।
প্রস্তাবিত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য চাঁদপুর জেলা প্রশাসন ১৯৪ কোটি টাকার প্রাক্কলন তৈরি করে। এ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে জেলা প্রশাসনের প্রাক্কলন সংশোধন চেয়ে গত বছরের নভেম্বরে ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান ও অন্যরা। পরে মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে ব্যাখ্যা জানতে চায়। চাঁদপুর জেলা প্রশাসন ব্যাখ্যা দিয়ে প্রতিবেদন পাঠায়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে গত বছরের ১৬ নভেম্বর চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত বছরের ৬ এপ্রিল চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সদর উপজেলার ১১৫ নম্বর লক্ষ্মীপুর মৌজার ৬২ দশমিক ৫৪৯০ একর ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১১ এপ্রিল জমির দাগসূচি চূড়ান্ত করে অধিগ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব পায় জেলা প্রশাসন।
ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করার পাশাপাশি আইন অনুসারে জমির গড়মূল্য নির্ধারণে নির্দেশনা চেয়ে সেলিম খান এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই ব্যক্তি হাইকোর্টে পৃথক রিট করেন। সেলিম খানের করা রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। অপর রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ৩০ নভেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। পৃথক রিটের ওপর একসঙ্গে শুনানি চলছে। আদালতে শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, প্রকৃত মৌজা দর ধরে জমি অধিগ্রহণের দাম নির্ধারণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে ৬২ একর জমির জন্য (মূল দামের তিন গুণ ধরে) সরকারের ব্যয় হবে প্রায় ১৯৪ কোটি টাকা। কিন্তু হঠাৎ উচ্চ মূল্য দেখিয়ে যেসব দলিল করা হয়েছে, সেটা আমলে নিলে সরকারকে ৫৫৩ কোটি টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ সরকারকে অতিরিক্ত দিতে হবে ৩৫৯ কোটি টাকা।