গ্রামের লোকজনকে যাতে চাকরির খোঁজে আর শহরে যেতে না হয় সে জন্য ‘প্রতি পরিবার থেকে একজনকে চাকরি দেওয়ার উদ্যোগ’ থাকছে আসন্ন বাজেটে। গ্রামকে শহরে রূপান্তর এবং প্রতি পরিবার থেকে চাকরি দেওয়া—এ দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েই এবারের বাজেট প্রণয়নের কাজ করছে অর্থ বিভাগ। ওই দুটি বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে নির্দেশনা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এ জন্য পল্লী খাতে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সজীব হোম রায়
সূত্র মতে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে আসন্ন বাজেট। মূল প্রতিপাদ্য ধরা হচ্ছে ‘গ্রাম হবে শহর’। গ্রামকে ধীরে ধীরে শহরে রূপান্তর করার রূপরেখা তুলে ধরা হবে বাজেটে।
জানা গেছে, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করবেন আগামী ১৩ জুন। পাঁচ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি অঙ্কের যে বাজেট তিনি উপস্থাপন করবেন তাতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকবে। প্রথমত, পুরো বাজেট সাজানো হচ্ছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তিতে। দ্বিতীয়ত, মানে ও আকারে বৃহৎ হলেও বাজেট হবে সংক্ষিপ্ত।
অর্থ বিভাগের বাজেটসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আসছে বাজেটে গ্রাম আধুনিকায়ন এবং বেকারত্ব কমিয়ে আনার প্রয়াস থাকবে। এ জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের একটি উদ্যোগকে রোল মডেল হিসেবে নেওয়া হচ্ছে। ভারতে ‘এক শ দিনে কর্মসৃজন’ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। উদ্যোগটি
ঘিরে বিতর্ক থাকলেও সফলতা পেয়েছে দেশটি। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফলতা মিলেছে। অনেকটা সে আদলে প্রাথমিকভাবে প্রতি রিবারের একজনকে চাকরি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে অর্থ বিভাগ। এ জন্য ‘কর্মসৃজন’ নামে আলাদা একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হতে পারে। এটি বাস্তবায়ন করা হতে পারে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমি জানি না অর্থমন্ত্রী প্রতি পরিবার থেকে কিভাবে চাকরির ব্যবস্থা করবেন। তবে এ উদ্যোগ যদি শুধু সরকারি খাতের জন্য নেওয়া হয় তাহলে কী লাভ হবে? বরং ব্যক্তিখাত বা প্রাইভেট সেক্টরের জন্য এ উদ্যোগ নিলে ফলপ্রসূ হবে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী যেটা বলেছেন, সেটাকে আক্ষরিক অর্থে না নিয়ে বড় পরিসরে নেওয়া উচিত। অর্থাৎ প্রতিটি পরিবার থেকে চাকরি মানে দুইটা লক্ষ্য পূরণ। একটি হলো দারিদ্র্যমুক্ত করা এবং অপরটি হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। দেশে যদি দারিদ্র্য কমে আসে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় তাহলে আয় বৈষম্য এমনিতেই কমে আসবে। তবে এটা এক দিনে সম্ভব না। গ্র্যাজুয়ালি সম্ভব। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। স্ট্র্যাটিজিক্যালি ব্যবস্থা নিলে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষত চর, হাওর এলাকায় কর্মসংস্থান সম্ভব। এ জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ চিকিৎসা, শিক্ষা খাতে উন্নয়ন করতে হবে। সারা দেশে এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন করলে কর্মসংস্থান হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘তবে এসব কাজ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব না। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে করতে হবে। সরকার শুধু এখানে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করতে পারে। গ্রামে শহরের মতো সুবিধা পাওয়া গেলে সেখানে বেসরকারি খাত এমনিতেই এগিয়ে আসবে।’
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আসছে বাজেটে সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সে জন্য প্রান্তিক কৃষক থেকে শুরু করে দিনমজুর যাতে উপকৃত হয় সে ব্যবস্থা রাখার চেষ্টা করছে অর্থ বিভাগ। জেলা, উপজেলা পর্যায়ে যেসব গ্রাম পিছিয়ে রয়েছে সেগুলো উন্নত হলে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে প্রান্তিক মানুষের ওপর। এ জন্য গ্রামে শহরের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার একটি রূপরেখা তুলে ধরা হবে বাজেটে।
সূত্র মতে, বাজেটে বেকারত্ব কমিয়ে আনা এবং তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার বেশ কিছু উদ্যোগের কথা থাকবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছায় এ উদ্যোগের কথা বিশেষভাবে বলা হবে। বাজেটসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রথমেই বেকারত্ব কমিয়ে আনা এবং শহর নির্ভরতা কমাতে হবে। অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে বিশেষ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। প্রতি পরিবার থেকে চাকরি দেওয়ার উদ্যোগ নিলে বেকারত্ব কমে আসবে বলে আশা করছে সরকার।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সাত বছরে বেকারত্ব দ্বিগুণ হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা চার কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, দেশে কর্মের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন মানুষের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার। তবে সংখ্যা যা-ই হোক, বেকারত্ব যে একটি বোঝা তা নিয়ে দ্বিমত নেই সরকারে।
গ্রামকে শহরে রূপান্তরিত করার কর্মপরিকল্পনা মতে, গ্রামে শহরের সব সুযোগ-সুবিধা মিলবে। ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ, পাকা রাস্তার ব্যবস্থা, অনলাইন ব্যাংকিং, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের সুবিধা দিতে দিকনির্দেশনা থাকবে বাজেটে। সে লক্ষ্যে পিছিয়ে পড়া গ্রামগুলোকে চিহ্নিত করে সেখানে ওই সব সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার কথা থাকবে বাজেটে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়ই বৃহৎ এ কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হচ্ছে। বাজেট বক্তৃতায় সে রূপরেখাই তুলে ধরবেন অর্থমন্ত্রী। গ্রামকে শহরে রূপান্তরিত করার জন্য গ্রামীণ অবকাঠামোতে বরাদ্দ বাড়ানো হবে। পাশাপাশি শহরের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের জন্য পল্লী এলাকার উন্নয়নে রাখা হবে বিশেষ বরাদ্দ। গ্রামে দারিদ্র্য বিমোচনেও বরাদ্দ বাড়ানো হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা ও বরাদ্দ দুটোই বাড়তে পারে।
জানা গেছে, বাজেটে মূল ফোকাস থাকবে পাঁচ ‘প্রো’। এগুলো হলো প্রো গ্রোথ, প্রো ডেভেলপমেন্ট, প্রো ম্যানুফ্যাকচারিং, প্রো এক্সপোর্ট এবং প্রো জব ক্রিয়েশন।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে প্রাথমিকভাবে একটি রূপরেখা ঠিক করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটের প্রাক্কলিত আকার পাঁচ লাখ ২৪ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ৫৯ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা বা ১১.৩৭ শতাংশ বেশি। আগামী অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মূল আকার এক লাখ ৯৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে এক লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ আছে।