জামায়াত-শিবিরের কার্যক্রম সক্রিয় থাকায় চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আসছে। বিশ্বদ্যিালয়গুলো হলো- সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, অতীশ দিপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাউথ এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। জামায়াত-শিবিরের পালিয়ে থাকা নেতাকর্মীরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার ছত্রছায়ায় সরকারবিরোধী আন্দোলন জাগিয়ে তোলা এবং তা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। একই সঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে গণরোষ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে তারা। সম্প্রতি এক গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
সম্প্রতি সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, অযোগ্য বিবেচিত হয়ে ৯ জন শিক্ষকের পদত্যাগ এবং উপাচার্য কিছুদিনের ছুটিতে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে জামায়াত-শিবির কর্মীরা চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক গোপন প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়াও বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো উপাচার্য পরবর্তীতে যোগদান করায় সাউথ ইস্টে ফের অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে অগ্রীম তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি এবং যেকোন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ডিএমপি কর্তৃক প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোপনীয় প্রতিবেদনে। সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ব্যতিত বহিরাগত ও স্থানীয় লোকজন যাতে এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে না পারে সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে সরকারবিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দল যাতে ইন্ধন যোগানো এবং আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে না পারে সে ব্যাপারেও তৎপর থাকার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ ব্যাপারে সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুস সবুর গতকাল বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন কোন সমস্যা নেই। এখানে জামায়াত-শিবিরের কার্যক্রমও নেই। ক্যান্টিনে কেনাকাটা নিয়ে সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল, সেটিও মিটমাট হয়ে গেছে। বাইরের কিছু লোক এসে এখানে ঝামেলা সৃষ্টি করেছিল।’ তিনি বলেন, ‘উপাচার্য ড. এএনএম মেসকাত উদ্দিন ছুটিতে যাননি। তিনি নিয়মিত অফিস করছেন।’
চারটি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যায়ন করছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। এর মধ্যে সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় দশ হাজার। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণকালীন শিক্ষক ২৫০ জন এবং খ-কালীন শিক্ষক আছেন ১৭০ জন। আর এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থী প্রায় ১২ হাজার এবং পূর্ণকালীন ও খ-কালীন শিক্ষক আছেন প্রায় আড়াইশ, অতীশ দিপঙ্করে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার এবং শিক্ষক আছেন প্রায় আড়াইশ। এছাড়া সাউথ এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে বলে জানা গেছে। চারটি প্রতিষ্ঠানই বনানীতে খুব কাছাকাছি এলাকায় অবস্থিত। তবে এশিয়ান ইউনিভার্সিটির উদ্যোক্তাদের কয়েক জনের বিরুদ্ধে ছাত্রশিবিরের কর্মীদের নানাভাবে সহযোগিতা করা এবং এই প্রতিষ্ঠানে কয়েক ডজন শিবিরকর্মী শিক্ষকতা করছেন বলে দু’জন শিক্ষক জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে অতীশ দিপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্ট্রোলার (পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক) প্রফেসর জাকির হোসেন বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির-এমনকি ছাত্রদলেরও কোন কার্যক্রম নেই। এখানে ছাত্রলীগের কার্যক্রম রয়েছে, যা সীমিত পরিসরে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার নেতৃত্বও দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ সমর্থকরা। কাজেই এখানে সরকারবিরোধী তৎপরতা চালানোর কোন সুযোগ নেই। এরপরও সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির আন্দোলনের পর আমরা অধিকতর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।’
অযোগ্যতার কারণে ভিসিসহ সাউথ ইস্টের ৯ শিক্ষকের চাকরি গেল
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের যোগ্যতা মূল্যায়নের একটি বিশেষ প্রোগ্রাম গ্রহণ করেন। এর আওতায় প্রতিষ্ঠানটির ১৫৩ জন শিক্ষকের যোগ্যতা মূল্যায়ন করা হয়। তিনটি আঙ্গিকে তাদের যোগ্যতা মূল্যায়ন করা হয়। মাপকাঠিগুলো হলো- ইন্টারভিউ বোর্ডের মাধ্যমে যোগ্যতা মূল্যায়ন, সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডিন কর্তৃক মূল্যায়ন এবং ছাত্রছাত্রী কর্তৃক শিক্ষকদের মূল্যায়ন। এ মূল্যায়নের ভিত্তিতে ৯ জন শিক্ষকের কার্যকলাপ ও পারফরমেন্স আশানুরূপ না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে বলেন, অন্যথায় তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি প্রদানের ঘোষণা দেন। এ প্রেক্ষিতে ৮ জন শিক্ষক স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন এবং একজন শিক্ষককে অব্যাহতি প্রদান করা হয়।’
চাকরি হারানো শিক্ষকরা হলেন বিজনেস স্টাডিস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেওয়ান মো. নুর-এ-ইয়াজদানি (অব্যাহতি), ইংরেজি বিভাগের সিনিয়র লেকচারার আবু নাঈম, বিজনেস স্টাডিস বিভাগের ইবনুল আজিজ, একই বিভাগের লেকচারার নিশাত আক্তার, রেবেকা সুলতানা লতা, নজরুল ইসলাম, শারমিনা আক্তার (দিশা), ইকবাল হোসাইন এবং সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মুরাদ কবীর নিপুন। তাদের মধ্যে নূর-এ-ইয়াজদানিকে গত ২৪ সেপ্টেস্বর অব্যাহতি দেয়া হয়। অন্যরা ২৮ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন।
জালিয়াতি ও প্রতারণা
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, নূর-এ-ইয়াজদানি বিজনেস স্ট্যাডিস বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে বিদেশ পাঠানোর কথা বলে টাকা নেয়ার পর পরবর্তীতে বিদেশে না পাঠাতে পারায় অভিযোগকারী ছাত্রছাত্রীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়। আর আটজন শিক্ষকের যোগ্যতা কর্তৃপক্ষের নিকট খুবই দুর্বল প্রতীয়মান হয়েছে। তবে শিক্ষক মুরাদ কবীর নিপুন অনৈতিকভাবে একজন ভারতীয় শিক্ষকের একটি জার্নাল নিজের নামে প্রকাশ করেছেন। ভারতীয় ওই শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এর ফলে তাকেও স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে বলা হয়, নতুবা অব্যাহতি দেয়া হবে বলে জানানো হলে তিনি পদত্যাগ করেন।
মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভিসি ড. এএনএম মেসকাত উদ্দিনের ডক্টরেট ডিগ্রি ভুয়া বলে তার পদত্যাগ দাবি, অব্যাহতি ও স্বেচ্ছায় পদত্যাগকারী শিক্ষকদের পুনর্বহাল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের দাবিতে গত ২ অক্টোবর সকালে সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের সামনে ২০০/২৫০ ছাত্রছাত্রী অবস্থান নেয় এবং তারা ভিসির বিরুদ্ধে নানা রকম স্লোগান দেয়। পরে দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মেজর জেনারেল (অব.) কাজী ফকরুদ্দীন আহমেদ বনানী ক্যাম্পাসে প্রশাসনিক ভবনের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা ভিসির পদত্যাগ এবং শিক্ষকদের পুনর্বহালের দাবি জানায়। এর প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে ভিসি কিছুদিনের জন্য ছুটিতে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি উপাচার্যের পদে ফিরে আসেন।
সৌজন্যে: দৈনিক সংবাদ