৫৪ ধারা ও ১৬৭ ধারার অপপ্রয়োগ রোধে এগুলো সংশোধনের জন্য উচ্চ আদালতের রায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। হাইকোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপি আমলে যে আপিল করা হয়, সেটি বর্তমান সরকারও সচল রেখেছিলো। এই পটভূমিতে সংবিধানপ্রণেতাদের অন্যতম ড. কামাল হোসেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রশ্ন: ক্ষমতাসীন দলকে কি বিব্রত বা দ্বিধাগ্রস্ত মনে হচ্ছে?
ড. কামাল হোসেন: তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হয় যে এই আপিলটি বিএনপি করেছিলো। এটাকে জোরালোভাবে রক্ষা করার চিন্তা তাদের করা উচিত নয়। দেশে স্বৈরতন্ত্রের সময় যেভাবে চলেছে, তাকে এখন সুরক্ষা দেওয়ার কোনো কারণ নেই। পাকিস্তান আমলে আমরা বলতাম ওনাদের ভুয়া কথা বলে ধরে রাখা হয়েছে। ১৯৮৩ সালে এরশাদের সময় শেখ হাসিনাসহ আমাদের ভুয়া কথায় ধরে নেয়া হলো। দেশে স্বৈরতন্ত্র থাকলে মানুষ বেআইনি গ্রেপ্তারের সম্মুখীন হয়, অযথা হয়রানির শিকার হয়। আবার প্রতিকারের পথগুলোও প্রশস্ত থাকে না। আমরা যদি গণতন্ত্র চাই, তাহলে আইনের শাসনকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। স্বৈরশাসনের সংস্কৃতি আমরা পুনর্বাসিত করতে পারি না। একটা সমাজে দীর্ঘদিন স্বৈরশাসন চললে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, গত ৪৫ বছরে সব সময় গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থাকেনি। ১৯৭৫ সালের পরে সংবিধান সামরিক শাসনের অধীন থেকেছে। আজ তো সংবিধানের সঠিক ব্যাখ্যা করতে হবে। কারো ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করতে হলে তার ও তার পরিবারের কাছে একটা সংগত ব্যাখ্যা দিতে হবে। তাকে বলতে হবে, ভাই তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি এই কারণে। তাকে জানাতে হবে, আমি অমুক থানার অমুক, আমার সঙ্গে আসুন। এখন কেউ যদি বলেন যে এ কথা বলা যাবে না, তাহলে দেশের নিরাপত্তাÿক্ষুণ্ন হবে, তারা কিন্তু না জেনেই বলেন। কারণ, এটা কোনো যুক্তি নয়।
প্রশ্ন: রিমান্ড বা গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করার বিষয়ে নিম্ন আদালতের একটা বিরাট ভূমিকা আইনে স্বীকৃত। ইদানীং কিছু রায়ের আলোকে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গাইডলাইন বা নির্দেশনা দিচ্ছেন।
ড. কামাল হোসেন: এটা খুবই যুক্তিসংগত কথা। এ ধরনের সুযোগ খোলা আছে। এই মামলায় উচ্চ আদালত নিজেরাই বুঝেছেন কীভাবে আইনের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। কীভাবে বাংলাদেশে সংবিধানে স্বীকৃত মানুষের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই ইতিহাসের ভুক্তভোগী আমরা স্বাধীনতার আগেও এবং পরেও। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর তো জানা আছে যে কীভাবে গ্রেপ্তারের আইনের অপব্যবহার করে চোখ বেঁধে মানুষকে ধরে নেওয়া যায়। বর্তমান মন্ত্রিসভার কয়েকজন তো আমার বাসা থেকেই গ্রেপ্তারের স্বাদ পেয়েছেন। মেননও তার একজন। কোনো কারণ দেখানো হয়নি। বলেছিলাম, কী করছেন? উত্তর এসেছে, আপনারা ষড়যন্ত্র করছেন, দেশদ্রোহিতা করছেন। কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছিল না বলেই ১৪ দিন পরে ছাড়তে হয়েছে। বর্তমান আইনমন্ত্রীর বাবা সিরাজুল হক আমাদের প্রিয় বাচ্চু ভাই, সৈয়দ ইশতিয়াকসহ ১৩ জনকে আটক করা হয়েছিল কোনো কারণ ছাড়াই। আদালতে নেয়ার সময় কানে এসেছে ওরা শকুন। সেই দিন তো আমরা পার করে এসেছি।
মানুষ আটকের ÿক্ষমতা রাষ্ট্রের নিশ্চয় থাকবে। কিন্তু চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়ার ৫৪ ধারা তো ৫৪ ধারা নয়। ৫৪ ধারা দুশ বছর চলেছে। সেটা তো চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যাওয়ার ধারা ছিল না। সুতরাং এর ব্যত্যয় ঘটেছে বলেই আজ সর্বোচ্চ আদালত এগিয়ে এসেছেন। একটা যুক্তিসংগত গ্রহণযোগ্য ও মানবিক ৫৪ ধারা থাকবে, চোখ বাঁধার ৫৪ ধারা থাকবে না। আদালত এটাই বলেছেন।
প্রশ্ন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ রায়ের আলোকে আইন সংশোধনের কথা বলেছেন।
ড. কামাল হোসেন: আলহামদুলিল্লাহ। আমি বিশ্বাস করতে চাই যে তাঁরা এটা কোনো অজুহাত হিসেবে বলছেন না, আন্তরিকভাবেই বলছেন।
প্রশ্ন: কিন্তু সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের রায় একটি আইন কি না এবং সেটা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আছে কি না?
ড. কামাল হোসেন: অবশ্যই। এটা যুক্তির কথা যে ৫৪ ও ১৬৭ ধারার বিষয়ে আমরা একটি আইন পাচ্ছি। এবং যেহেতু প্রধান বিচারপতি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ব্যাপারে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বিধি চালু করেছেন, তাই আমরা খুব শিগগিরই আদালতের আইন বা তাঁদের রায় পাব। এক-দেড় বছর ঝুলে থাকবে এমন আশঙ্কা করি না। তদুপরি আমরা মন্ত্রীদের আশ্বস্ত করার সূত্রেই বলতে চাই, আসুন আমরা এখনই একটি গোলটেবিল সভার আয়োজন করি। সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে, সেটা আমরাও খতিয়ে দেখতে পারি। যুক্তিসংগত হলে তা আমরা মেনে নিয়ে সে অনুযায়ী সুপারিশ রাখতে পারি। সরকারকে ১০০ ভাগ সাহায্য করতে চাই। আমরা সবাই মিলে দেখতে পারি, একটি সভ্য রাষ্ট্রে কীভাবে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়। এটা এ দেশে সম্ভব। কারণ, এককালে আমরা এটা করে দেখিয়েছি। আপিল বিভাগ এমন কিছু করেননি, যা নতুন বা অভাবনীয়।
প্রশ্ন: এতো দিন তো রায়ের ওপর কোনো স্থগিতাদেশ ছিল না?
ড. কামাল হোসেন: না, ছিল না।
প্রশ্ন: এখন আমরা যদি দ্রুত রায় পাই তাহলেও সেই দ্রুততায় আইন না-ও পেতে পারি। তাহলে রায় কার্যকর হওয়ার আশা করব কীভাবে?
ড. কামাল হোসেন: এখানে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আমরা এখানে ব্যবহার ও অপব্যবহার দুটোই তো দেখেছি। এই উপমহাদেশের উচ্চ আদালতগুলো এ বিষয়ে রায় দিয়েছেন। দশকের পর দশক আমরা গোটা উপমহাদেশে এর অনুশীলন দেখেছি। সুতরাং আমি তো এটা ভাবতেই পারি না যে কেউ ভাব নেবেন এই বলে যে, এটা নিয়ে ভাবতে বসে যেতে হবে। আগে হাইকোর্টের রায়ে ১৫ সুপারিশ আছে, সেগুলো শুনানিতে আলোচনায় এসেছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা গণতন্ত্রের মুকুট। এটা তো কল্পনা করে খর্ব বা হরণ করা যাবে না। এটা খুবই পরিষ্কার একটি বিষয়। সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খুশিমতো বঞ্চিত করা যাবে না।
কৃতজ্ঞতায় দৈনিক প্রথম আলো
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।