ছাত্রনেতৃত্ব থেকে কি পাচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা? - দৈনিকশিক্ষা

ছাত্রনেতৃত্ব থেকে কি পাচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশের মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্র রাজনীতি ও ছাত্রদের অবদান এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারিকৃত প্রশাসনিক আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেছিলেন। ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর নির্মমভাবে পুলিশের গুলিবর্ষণ হয় এদেশেরই ভাষা রক্ষায় রক্তক্ষয়ী তরুণেরা। রফিক, সালাম, বরকত ও আবদুল জব্বারসহ আরও অনেক শহীদের রক্তে রাজপথে স্বাধীনতার বীজ নতুন করে বপন হয় সেদিন। তাইতো সহস্র প্রজ্বলিত যুবকের আত্মত্যাগের কথা স্থান পেয়েছে গল্প-উপন্যাসে। এসব গল্প-কাহিনী আমাদের বীরের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা জোগায়। কিন্তু আজকের এক শিক্ষার্থী যখন আরেক শিক্ষার্থীর জন্য কাল হয়ে ফেঁপে ওঠে তখন আধুনিক যুগের যেসব ঘটনা বা গল্প-কাহিনী তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে গৌরবের অধ্যায় না হয়ে লজ্জাজনক ইতিকথা হয়ে উঠবে। তাদের মাঝে তখন সেগুলো অনুপ্রেরণার গল্প না হয়ে ভীতি বা আতঙ্কের কাহিনী হিসেবে স্মরণ থাকবে। সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা। তার ওপরে বারবার অতর্কিত হামলার ঘটনা এটাই প্রমাণ করে সরকারের মতবিরোধী সমালোচকরা দেশে নিরাপদভাবে চলাচল করতে পারবে না। এর প্রমাণস্বরূপ বলা যেতে পারে ভিপি নুর তার নিজস্ব ছাত্রসংগঠন ‘সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ থেকে যতগুলো আন্দোলন করেছিলেন এর প্রত্যেকটি সরকারবিরোধী। এছাড়াও তার ওপরে হামলার প্রতিবাদে রংপুরে ‘সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের’ বের করা মিছিলের ওপরে আক্রমণ করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। সেগুলো কত যৌক্তিক বা অযৌক্তিক সেটা রাষ্ট্রের ভাবনার বিষয়। আমি কোন ছাত্রনেতার পক্ষপাতী নই তবে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে। কেননা দেশের বড় বড় ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রধান নেতৃত্ব নিয়ে যখন নানাবিধ প্রশ্ন ওঠে তখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের পথপ্রদর্শন অনুসরণ করে কিভাবে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করবে সেটাও একটা জিজ্ঞাসার ব্যাপার। বেশ কিছুদিন আগে ডাকসু ভিপি নুরের যে ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে এ নিয়েও মিডিয়ায় বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। আয়োজন হয়েছিল বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে ডাকসুর বিভিন্ন সদস্যসহ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে মুখোমুখি ‘টক শো’র আয়োজন। সামনা-সামনি সেসব বিতর্কে ডাকসু সদস্যদের শুধু তাদের বিরুদ্ধে আনীত বিভিন্ন অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। সেসব অনুষ্ঠানে একটিবারের জন্যও কেউ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমস্যা কি, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র আলোচনা করতে দেখা যায়নি। অথচ যেখানে শিক্ষার্থীদের সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং তা নিরসনের উপায় তাদের প্রধান বক্তব্য হওয়ার কথা ছিল। সেসব মঞ্চ হয়েছে যেন সরকার এবং বিরোধী দলীয় একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতার মঞ্চ। প্রসিদ্ধ একটা প্রবাদ রয়েছে ‘একতাই বল, একতাই শক্তি’ অর্থাৎ সংবদ্ধ চিন্তার দ্বারা যেকোন দুঃসাধ্যের সুরাহা মিলে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর সদস্যদের মাঝে যে ঐক্য ও সংহতির বড়ই অভাব তা এখন আর অ¯পষ্ট নেই। সংগঠনই যেখানে বিশৃঙ্খল সেখানে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মাঝে শান্তি-শৃঙ্খলা আনয়ন ব্যাঙের সর্দির সমতুল্য।

বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যার পর দেশে সাধারণ ছাত্রসমাজে যে জোরালো আন্দোলন ও সচেতনতার ভিত্তি দেখা যায় এরপর অনেকে ভেবেই নিয়েছিলেন হয়তো পরবর্তী কয়েক বছর দেশে ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনা কমে যাবে। কিন্তু সেটি ছিল নিছক কল্পনা মাত্র। ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের সদস্যদের সঙ্গে ডাকসু ভিপি নুরুলের সমর্থকদের দুই পক্ষের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। অতঃপর সর্বশেষ হামলার ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যারও চেষ্টা করা হয়। আমার বারবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক নেতৃত্ব নিয়ে দর কষাকষির কারণ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালি ঐক্যের একটি বড় জাগরণ সেখান থেকেই উত্থান ঘটে। ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচার ও সামরিকতন্ত্রের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণে সাহায্য করেছে ‘ঢাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ বা ডাকসু।

এভাবে চলতে থাকলে এ স্বাধীন ভূখণ্ডের সুদূরপ্রসারী নেতৃত্ব হবে দুর্বল চেতনার। কেননা আজকে যারা দেশের প্রধান প্রধান ছাত্র সংগঠনগুলোয় নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারাই হবেন আগামীর রাষ্ট্র পরিচালনার সম্ভাবনাময় নির্দেশনাকারী। কিন্তু সেই সামনের সম্প্রীতির বাংলাদেশকে উন্নতির শেখরে পৌঁছানোর মতো নেতাকর্মীর সংকট যে নিশ্চিত তার প্রতিক্রিয়া এখনি দেখা দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমৃদ্ধির দেশ গড়ার লক্ষ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। কিন্তু আমরা তাকে কতটুকু সহযোগিতা করছি? যখন যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দলের ছাত্রসংগঠনের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি কিংবা সহিংসতার কথা যেন নৈমিত্তিক ব্যাপার।

‘অপরাধী যেই হোক না কেন দলমত নির্বিশেষে সে একজন অপরাধী’ দলের মূল নেতারা মিটিং-সমাবেশে এমন ধরনের মন্তব্য করতে বারবার শোনা গেলেও বাস্তব ক্ষেত্রে যেন এর বাস্তবায়ন পুরোপুরি মিলছে না। তাই এ ব্যাপারে বেশ কিছু সজাগ দৃষ্টি অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত যেসব কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে সেগুলোর কারণ চিহ্নিত করতে হবে। অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার মাঝেই এর একমাত্র সমাধান অন্তর্নিহিত নয়। বের করতে হবে এসব অসন্তোষজনক ঘটনার মূল উৎস কোথায়। তা না হলে এরকম অসংগতি প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকবে। এর জন্য সবচাইতে আগে এগিয়ে আসতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসকদের। যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের মাঝে অন্তঃকলহ দেখা যায় তখন তারা নীরব ভূমিকা পালন করে। পরিবেশ স্থিতিশীল হওয়ার পরবর্তী সময়ে তাদের সে বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অপরদিকে অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঠিক ঘটে কিন্তু পরিশেষে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা হয় না। তাই অপরাধী যেই হোক না কেন তাদের আইনের অধীনে আনা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বড় বড় ভাইরাল সাংঘর্ষিক ব্যাপারগুলোয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যরা উচ্চ প্রশাসন থেকে নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকে। অস্থিরতা তৈরির তাৎক্ষণিক পর্যায়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার তেমন কোন পদক্ষেপ দেখা যায় না। এই নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

সেলিনা হোসেনের স্বাধীনতা বিষয়ক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ এ গ্রামের দুরন্ত কিশোরী বুড়ির অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার কাহিনীতে যে বীরত্ব গাঁথার পরিচয় মেলে তা সত্যিই গর্বের। দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় একজন মা, মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে তার নিজের আদরণীয় সন্তানকে তুলে দেয় পাকিস্তানি বাহিনীর বন্দুকের নলের মুখে। কিন্তু আজকালকার চিত্রটা যেন একটু ভিন্নমতের কথা বলে। বর্তমান অনেক অভিভাবক তাদের ছেলেদের কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকতে বারণ করেন। তাদের মনে ভয় কাজ করে রাজনীতি মানেই মারামারি আর সংঘর্ষ। দুশ্চিন্তা থাকে ছেলে হারানোর। অপ্রিয় হলেও সত্য এখন ছাত্রসংগঠনগুলোর আন্দোলন বা সমাবেশের স্লোগানগুলোয় উগ্রবাদী চেতনার আভাস পাওয়া যায়। শোডাউনে রামদা, রড, লাঠিসোটা ইত্যাদি অস্ত্র অনেকটা প্ল্যাকার্ডের স্থান দখল করে নিয়েছে। ‘ধর ধর ওমুক ধর’, ‘ওমুক ধরে জবাই কর’, ‘অ্যাকশন অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ - এমনি সব কঠোরভাবাপন্ন উক্তি ছাড়া যেন আন্দোলনের পরিপূর্ণতা পায় না। অথচ একজন কোমলমতি শিক্ষার্থীর মুখ থেকে এমন ধরনের বাক্য উচ্চারণ কখনই সুশীল সমাজে কাম্য নয়।

শুধু তাই নয় সাধারণ বহু ছাত্রদের মাঝে নেতৃত্ব বিকশিত হওয়ার সুপরিচালিত রাজনৈতিক পথ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা জন্মেছে। এই বিরূপ ধারণার নিস্তার সময়ের দাবি। দেশের বড় বড় দলীয় সংগঠনের প্রধান নেতাদের এ নিয়ে নিগূঢ় ভাবনার সময় এসেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি হোক কলুষমুক্ত। স্থিতিশীল পরিবেশ গড়ে উঠুক প্রত্যেকটি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোয়। ন্যায্য আন্দোলনগুলো অস্ত্র দ্বারা নয় গর্জে উঠুক যৌক্তিক উচ্চকণ্ঠে। তবেই উজ্জ্বল ছাত্রনেতৃত্ব দানা বাঁধবে।

সাজ্জাদ হোসেন : শিক্ষার্থী, সামাজ বিজ্ঞান অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? - dainik shiksha শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ - dainik shiksha অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে - dainik shiksha সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032927989959717