আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। গত ২২ ডিসেম্বর রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নূর এবং তার অনুসারীদের ওপর হামলার যে ঘটনা ঘটেছে তাতে কেউই নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় কোনো পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর অভিভাবক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ছোটখাটো ঘটনা ঘটেই থাকে। হল দখল, চাঁদাবাজি প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে অসংখ্য ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এমন অবাঞ্ছিত ঘটনার কোন বিচার হয়নি আজও পর্যন্ত; যা সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের আত্মবিশ্বাসের মূলে আঘাত করেছে। আর তাই আমাদেরও ধারণা জন্মেছে এসব অপরাধের কোনো বিচার হয় না। শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহদের হত্যাকা-ের বিচারের মধ্য দিয়ে আমরা আশার আলো দেখছিলাম। শুধু আবরার নয়, বিশজন প্রতিভার মৃত্যু আমাদের যেমন ব্যথিত করেছে তেমনি আইনের প্রতি আমরা হয়েছি শ্রদ্ধাশীল। বুয়েটে অতি মেধাবী ছাত্র ছাড়া লেখাপড়ার সুযোগ হয় না। কিন্তু কলেজ জীবন থেকে এসে এসব ছাত্র হঠাৎ দানবের রূপধারণ করে আবরারের মতো তার ছোট ভাইকেও নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করতে দ্বিধা করে না। বুয়েটে আবরারের ঘাতকদের বিচার হচ্ছে ঠিকই কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, শুধু বিচারেই কি সমস্যার সমাধান হবে? না। এদের দানবীয় রূপের পেছনে গিয়ে মূল সমস্যার সমাধান করতে হবে।
ডাকসু ভবনে হামলা হয়েছে। ভিপি নুর তখন তার সহযোগীদের সাথে কথা বলছিলেন। হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ব্যানারের কতিপয় সন্ত্রাসী হামলা চালায় তাদের ওপর। এমনকি দু’জন ছাত্রকে ধরে ছাদ থেকে ফেলে হত্যার চেষ্টা করে। সে দু’জন ছাত্র এখনও ঢামেক আইসিইউতে জীবনের সাথে যুদ্ধ করছে। কিন্তু প্রশ্ন হল এরা কারা? মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ এবং ছাত্রলীগ সমমনা ছাত্র সংগঠন।
২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ গঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ থেকে পদ না পাওয়া আকম জামাল উদ্দিন আহ্বায়ক এবং আসিবুর রহমান খান সদস্য সচিব হয়ে কমিটি গঠন করেন। সংগঠনের মূলমন্ত্র ছিল মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের সুবিধাদি আদায় করা। কিন্তু তারা ছাত্রলীগের সাথে এক সময় একাকার হয়ে যায়। ছাত্রলীগও তার দুর্নাম ঘোচাতে বিভিন্ন সময় এদের ব্যবহার করে থাকে। ভিপি নূরের ওপর আক্রমণে এরাই অগ্রগামী ছিল। তাই তো এদের দুজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
নূরের ওপর আক্রমণের পর বলা হচ্ছে ভিপি নূর বহিরাগতদের সাথে কোন ষড়যন্ত্র করেছিলেন। কিন্তু এ কথা তো প্রশাসনকে জানানোর কথা কিন্তু তারা তা না করে আইন কেন তাদের হাতে তুলে নিলেন? ডাকসু ভিপির ওপর হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সারাদেশ আজ উত্তাল সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে। আমরা উগ্রতা এবং নাশকতায় বারবার সরকারি দলের এই সহযোগী সংগঠনটিকে দেখছি। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে চাঁদা দিতে হয়েছে। গোটা প্রশাসন তাদের তোয়াজ করেই টিকে আছে। সাধারণ ছাত্র-শিক্ষকরা ভিসির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন ছাত্রলীগের ক্যাডাররা ভিসির সমর্থনে সাধারণ ছাত্র-শিক্ষকদের পিটিয়েছে। ভিসি তাতে উল্লসিত হয়ে মহাসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
ছাত্র রাজনীতি বা ছাত্রলীগের রাজনীতি বন্ধ হোক তা আমরা চাই না। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত এ ছাত্রদের ভূমিকাই ছিল অগ্রগণ্য। সেই ছাত্র রাজনীতিই আমরা চাই। আমরা চাই ছাত্রবান্ধব ছাত্র রাজনীতি। লুটেরা বা খুনের রাজনীতি নয়। ছাদ থেকে ফেলে হত্যার রাজনীতি নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন, সন্ত্রাস যথেষ্ট হয়েছে। এখন শান্তি ফিরে আসুক এটাই আমাদের কাম্য। যথেষ্ট হয়েছে এখন এই কালচার থামাতে হবে। এখানে কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছতা না থাকলে এ ধরনের আরাজকতা আরও পাকাপোক্ত হবে। আমরা শিক্ষাঙ্গনের পরিসরকে স্বচ্ছ দেখতে চাই। এখানে জ্ঞানমুক্ত চিন্তা ও সাংস্কৃতিক চর্চা হবে এটাই কাম্য, খুনোখুনি উগ্রতা আর দেখতে চাই না।
কতগুলো প্রশ্ন এখানে প্রাসঙ্গিক-নুরুল হক নূর একজন ব্যক্তিই নন। তিনি ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি। অথচ তিনিই বারবার মারধরের শিকার হচ্ছেন কেন? যেখানে ভিপি নিজেই নিরাপদ নন সেখানে শিক্ষার্থীরা কতটুকু স্বস্তিতে রয়েছেন সহজেই অনুমেয়। শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে রয়েছে কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছে না। বর্তমানে প্রযুক্তির কারণে অনেক কথাই বলা যাচ্ছে না, আন্দোলনও করা যাচ্ছে না ভয়ে। সামান্য ঘটনা মুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল। এর মধ্য দিয়েও অবাক করার মতো কা- ভিপির রুমের বাইরের সিসি ক্যামেরাগুলো হাওয়া হয়ে গেছে।
ছাত্র রাজনীতির এই পরিণতির জন্য মূলত রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। দায়ী বিশ্ববিদ্যায়ের দলবাজ প্রশাসনও। বিশ্ববিদ্যালয়ের দলবাজ প্রশাসনের নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব, নিষ্ক্রিয়তা এবং দলগুলির প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ইঙ্গিতে অথবা নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে হচ্ছে অস্থিরতা, সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনে। আমরা ডাকসু নির্বাচনেও এ ধরনের অস্থিরতা দেখেছি। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে নির্বাচন। খোদ রাষ্ট্রপতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মোদ্দাকথা হলো-বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে জবাবহিদিতা থাকতে হবে, হতে হবে স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল, পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তাহলেই হয়ত সম্ভব হবে এ অবস্থান নিরসন করা।
নুরের ওপর হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, সরকারের মতবিরোধীরা বা সমালোচকরা নিরাপদে চলাচল করতে পারবে না। নূর তার নিজস্ব সংগঠন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে যতগুলো আন্দোলন করেছেন তা সবই সরকারবিরোধী। কোনো ছাত্র নেতা বা নূরের পক্ষে আমার এ লেখা নয়। তবে প্রতিপক্ষের ভাবা উচিত ছিল নূরের বক্তব্য, একমত হতেই হবে এমন কথা নেই, তবে বিরুদ্ধ মতকে প্রকাশ করবার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু তা না করে বিেেরাধী মতকে সন্ত্রাসের ভাষায় মোকাবিলা করা হয়েছে। একবারও ছাত্রলীগ বা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতারা বোঝার চেষ্টাও করেননি ছাত্র রাজনীতির গৌরবময় ইতিহাসের কথা। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন ’৬৯-এর গণআন্দোলন এবং ’৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলন ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসের কথা। নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতেই ছাত্রলীগের মধ্যে এমন সন্ত্রাসী কর্তৃত্ব বাসা বেঁধেছে।
এভাবে চলতে থাকলে আগামী নেতৃত্বও হবে এমন একনায়ক ও সন্ত্রাসী মনোভাবের। যার ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বও হবে দুর্বল চেতনার। কারণ ছাত্র রাজনীতি থেকেই বেরিয়ে আসে ভবিষ্যৎ নেতা। ভবিষ্যতের রাষ্ট্র পরিচালনার সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব। কিন্তু বর্তমান ঘটনাসমূহ আমাদের নিরাশ করেছে। জাতির জনকের নির্দেশিত পথ থেকে তারই নিজ হাতে গড়া ছাত্র সংগঠন আজ স্খলিত হচ্ছে; যা সত্যিই দুঃখজনক।
শিক্ষাঙ্গনে এ অবস্থা কোনরকমে বরদাস্ত করা সরকারের কি উচিত হচ্ছে? যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা ঘটুক না কেন তার মূলে হাত দিতে হবে এবং উপড়ে ফেলতে হবে।
ডাকসু নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী নিজ কার্যালয়ে ডেকে নূর এবং সাদ্দামকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন সহমর্মিতার কথা। কিন্তু তার কথারই বা কী মূল্যায়ন করলেন সাদ্দাম?
এ বিভীষিকা আর ছড়াতে দেয়া যাবে না। কঠোর হাতে দমন করতে হবে। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এ ইতিহাস লজ্জার ইতিহাস হয়েই রয়ে যাবে।
লেখক : সামসুজ্জামান।