জাগ্রত হোক বিবেক - Dainikshiksha

জাগ্রত হোক বিবেক

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু |

কিছুদিন আগেও দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভ আর আন্দোলন চলছিল শিশুহত্যা আর নির্যাতন নিয়ে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র বিক্ষোভ।

এ দেশে ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন ও অপহরণের ঘটনা যে নাটকীয়ভাবে বেড়ে চলছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা টেলিভিশনের সংবাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলে প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে এ-সংক্রান্ত সংবাদ। জাতি হিসেবে এসব সংবাদ নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য চরম লজ্জা ও অপমানের। এসব ঘটনা বহির্বিশ্বে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করছে।

‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’, ‘আজকের শিশুরাই ভবিষ্যৎ জাতির কর্ণধার’, ‘ভবিষ্যতে আজকের শিশুরাই দেশ-জাতির নেতৃত্ব দেবে’- এমন সব কথাবার্তা বিভিন্ন সভা-সেমিনারসহ নানা জায়গায় বলা হলেও বাংলাদেশের শিশুদের সামগ্রিক চিত্র ভয়াবহ। এ দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া সম্ভব নয়। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী এ দেশে প্রায় এক কোটিরও বেশি শিশুশ্রমিক কর্মরত। শিশুশ্রমের পাশাপাশি অবৈধভাবে অর্থ আদায় বা মুক্তিপণ, পারিবারিক কলহ, দারিদ্র্য, পিতা বা মাতার পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়া, জমিজমা নিয়ে বিরোধ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, মা-বাবার সম্পর্কের জটিলতাসহ নানা কারণে শিশুহত্যার মতো জঘন্য ও ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে চলেছে। এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় সম্প্রতি হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার সুদ্রাটিকি গ্রামের চার শিশু হত্যার ঘটনা এবং রংপুরের মিঠাপুকুর এবং টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলা থেকে তিনটি শিশুর লাশ উদ্ধারের ঘটনার মধ্য দিয়ে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, ২০১২ সালের শুরু থেকে ২০১৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৯৫০টিরও বেশি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালে ২০৯, ২০১৩ সালে ২১৮ এবং ২০১৪ সালে ৩৫০ শিশু খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর গত বছরের অর্থাৎ ২০১৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত শিশু খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৯১টি। শিশুদের নিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ১৯৯টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ঠিক পরের বছর ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫২১, যা ২০১৪ সালের তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ৬৭টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে পাঁচজন হয় গণধর্ষণের শিকার। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় দুই শিশুকে। এ ছাড়া সংগঠনটির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালে ৮৬ শিশু, ২০১৩ সালে ১৭০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালে সারা দেশে ২১ হাজার ২২০টি নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।

এবার আসা যাক ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা প্রসঙ্গে। দেশে শিশুশ্রম, শিশু অপহরণ, নির্যাতন আর শিশু হত্যার মতোই বেড়ে চলেছে ধর্ষণের ঘটনা। কোথাও কোথাও নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে, আবার অনেক সময় পাশবিক নির্যাতন করে গুম করেও ফেলা হচ্ছে। সমাজের নিুবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত নারীরা কোনো না কোনোভাবে নির্যাতন-ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। দেশে নারীদের সুরক্ষায় আইন থাকলেও তা যেন কাজে আসছে না। ফলে ধর্ষণের ভয়াবহতা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। নারীদের পাশাপাশি কোমলমতি শিশুরাও এ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা যেমন থেমে নেই, তেমনি ধর্ষিত হওয়ার কারণে অপমানিত হয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও থেমে নেই। কারণ আমাদের সমাজব্যবস্থায় কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে প্রথমে সে পরিবারে এবং পরে সমাজে নিগৃহীত হয়। অথচ এ পরিস্থিতির জন্য সে দায়ী নয়।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে সারা দেশে ৮৪৬ নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী সময়ে ৬০ জনকে হত্যা করা হয়। অপমানে আত্মহত্যা করে দুজন। আর ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার হয় ৭০৭ জন। দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী ও শিশুরাও ধর্ষণ ও হত্যা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। মানবাধিকার সংগঠন কাপেংয়ের ‘বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার প্রতিবেদন ২০১৫’তে দেখা যায়, গত বছর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ১৩ জন খুন হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন নারী ও শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।

প্রকৃত বিষয় হচ্ছে, খবরের কাগজে যা দেখা যায় ধর্ষণের প্রকৃত ঘটনা তার চেয়েও বেশি। অনেক সময় অপরাধীরা মনে করে, ভিকটিম মামলা করবে না বা মামলা করেও কোনো কিছু করতে পারবে না। এ কারণেও ধর্ষণের প্রবণতা বাড়ছে। অনেক সময় ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় মামলা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিচার পায় না ভুক্তভোগী নারী বা শিশু। এমনকি অনেক সময় ধর্ষণের ঘটনায় মামলা করে আসামিপক্ষের অব্যাহত হুমকির মুখে নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে হয় ঘটনার শিকার নারী বা শিশুকে অথবা তাদের পরিবারকে। এ ধরনের পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে একটি দেশের জন্য, একটি সমাজের জন্য উদ্বেগজনক এবং তা ওই দেশের ও সমাজের নাজুক আইনশৃংখলা পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত দেয়।

এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যাবে, বর্তমান সমাজ এক ধরনের ‘পরিবর্তনের’ মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আর অনেকে এর সঙ্গে তাল মেলাতে না পারার কারণে সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। যার ফলে এ ধরনের অপরাধের মাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত আইন ব্যবস্থা, পুরুষদের মনমানসিকতার পরিবর্তন না হওয়া, পশ্চিমা সংস্কৃতি ও বিশ্বায়নের ক্ষতিকর প্রভাবের ফলেও দেশে ধর্ষণ আর হত্যার মতো নৃশংস অপরাধের ঘটনা ঘটে চলেছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পুলিশি সহায়তা না পাওয়ায় ভিকটিমদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার আতংক বিরাজ করছে। আসামিরাও হচ্ছে উৎসাহিত।

দিন দিন নারী ও শিশু ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের মতো বেদনাদায়ক ও জঘন্য ঘটনা বৃদ্ধি পেলেও এ ব্যাপারে যেন কারও টনক নড়ছে না। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিংবা পেশিশক্তির জোরে অনেক সময় পার পেয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে না পারলে আগামীতে পরিস্থিতি যে আরও ভয়াবহ হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

দুঃখের বিষয়, দেশে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেলেও এসবের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা। এক্ষেত্রে দ্রুত স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অপরাধীদের যে কোনো উপায়ে এবং রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা বা ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম একেবারে শুরু থেকে ঢেলে সাজাতে হবে। যেমন- আমাদের দেশে ধর্ষিত হওয়ার পরও ধর্ষিত নারীকেই প্রমাণ করতে হয় তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন (এ যেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাদম্বিনী’ গল্প!)। এক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা জরুরি। এ ব্যাপারে সুশীলসমাজ, মানবাধিকারকর্মী, গণমাধ্যম, সর্বোপরি দেশের সর্বস্তরের মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি নারী ও শিশু নির্যাতনকারী, ধর্ষণকারী অপরাধীরা যেন কোনোভাবেই শাস্তির আওতার বাইরে না থাকে- এ ব্যাপারে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।

ধর্ষণ, হত্যাসহ শিশুহত্যা, শিশু নির্যাতন ও শিশু অপহরণের সঙ্গে জড়িতদের ‘মানবতার শত্রু’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের যে কোনো উপায়ে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজনে এসব জঘন্য অপরাধীর বিচারের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়নসহ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তবে এ ধরনের অপরাধ বন্ধে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সামগ্রিকভাবে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা, প্রয়োজন মানুষের বিবেকবোধকে জাগ্রত করা।

লেখক: ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু, বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য।

স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032858848571777