জাতীয়কৃত ১০ স্কুলের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন - Dainikshiksha

জাতীয়কৃত ১০ স্কুলের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি |

সবার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণ করেছে। কিন্তু ঠাকুরগাঁওয়ে তৃতীয় ধাপে সরকারি গেজেটভুক্ত ১০টি বিদ্যালয়ের পরিবেশ ও শিক্ষার মান অত্যন্ত নাজুক। বিদ্যালয়গুলোতে নেই ভালো অবকাঠামো, আকর্ষণীয় বা শিশুবান্ধব শ্রেণিকক্ষ। বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত ছাত্র-ছাত্রী নেই। শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে আসেন নিজেদের ইচ্ছামতো। এসবের পেছনে সরকারিভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরাল না হওয়া, টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ ও জনপ্রতিনিধিরা দায়ী বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বুধবার দুপুর ১২টা। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার দক্ষিণ বঠিনা রিভার ভিউ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনটি শ্রেণিকক্ষের একটিতে তিন শিক্ষার্থী গল্প করছে, আরেকটিতে দুজন বই পড়ছে, অন্যটিতে তিন শিক্ষার্থীকে পাঠ দান করছেন শিক্ষক রিতা রানী রায়। আর শিক্ষকদের কক্ষে মোবাইল ফোনে কথা বলছেন শিক্ষক বিনোদা রানী রায়। পরে রিতা রানী শিক্ষকদের কক্ষে এসে বসলেন। বিদ্যালয়ের চার শিক্ষকের মধ্যে এই দুজন উপস্থিত। রিতা রানী জানান, একজন শিক্ষিকা ছুটিতে আছেন, প্রধান শিক্ষক জরুরি কাজে সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসে গেছেন। জানতে চাইলে বিনোদা রানী বলেন, বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী ১০০ জনের বেশি। কিন্তু সব শ্রেণিকক্ষ ঘুরে পাওয়া গেল মাত্র ৯ জন শিক্ষার্থীর উপস্থিতি। এই অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান এবং তড়িঘড়ি করে হাজিরা খাতায় ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিত চিহ্ন দেওয়া শুরু করেন। এভাবে ৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে উপস্থিত দেখানো হলো। এর কারণ জানতে চাইলে সদুত্তর দিতে পারলেন না শিক্ষক দুজন। একই অবস্থা সদর উপজেলার ধামডাঙ্গী, বন্দরপাড়া, দেওগাঁও রজনীগন্ধা, পশ্চিম বাগুলাডাঙ্গী পিপি, মহব্বতপুর সাজগাঁও, আরাজি পাহাড়ভাঙ্গা আদর্শ, আখানগর বয়তালপাড়া নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর। কিছু শিক্ষার্থী নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলছে এসব বিদ্যালয়।

সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিজস্ব জায়গায় ঘর, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ (ক্লাসরুম), আসবাবপত্র, খেলার সরঞ্জামসহ রেজিস্ট্রেশন বা জাতীয়করণ হতে কমপক্ষে ১৫০ জন শিক্ষার্থী প্রয়োজন। অথচ এই নতুন বিদ্যালয়গুলোয় এর সবই অনুপস্থিত। বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীসংখ্যা ৫০ জনের কম। বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত অবস্থাও নাজুক। জোড়াতালি দিয়ে বাঁশের খুঁটি-বেড়া ও ওপরে টিন দিয়ে তৈরি ঘরে পড়ানো হয় শিক্ষার্থীদের। তাহলে কিভাবে সরকারীকরণ হয়েছে এসব বিদ্যালয়?

দক্ষিণ বঠিনা রিভার ভিউ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রিতা রানী রায় জানান, কয়েক বছর ধরে এই বিদ্যালয়ের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন তিনি। এখানে চাকরির জন্য দিতে হয়েছে এক লাখ টাকা। একই কথা জানান শিক্ষক বিনোদা রানী ও সদর উপজেলা বন্দরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিমলা রানী সাহা। তাঁরা জানান, তৃতীয় ধাপে ১০টি বিদ্যালয় সবেমাত্র সরকারীকরণ হয়েছে; এখন পর্যন্ত শিক্ষকদের বেতন দেওয়া শুরু করেনি সরকার। কয়েক মাসের মধ্যেই বেতন হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা। এক প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা জানান, বিদ্যালয়গুলোতে এখনো উপবৃত্তি চালু না হওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা একটু কম। উপবৃত্তি চালু হলে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বাড়বে। শিক্ষকরা নিজ উদ্যোগে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীসংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।

দক্ষিণ বঠিনা রিভার ভিউ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণির জেসমিন আক্তার, চতুর্থ শ্রেণির সজিব ইসলাম ও আশা আক্তার জানায়, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসে না। সূত্র মতে, নিয়মিত ছাত্র-ছাত্রীরা সকাল ১০টার আগেই বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। কিন্তু বেশির ভাগ দিনই শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে আসেন ১১টার পরে। ধামডাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র কমল সরকার জানায়, তাদের শ্রেণিতে শিক্ষার্থীসংখ্যা পাঁচজন। গোবিন্দ সরকার মাঝেমধ্যে বিদ্যালয়ে আসে, কিন্তু অন্যরা তেমন আসে না। চতুর্থ শ্রেণির শ্রাবন্তী রানী জানায়, তাদের শ্রেণিতে ছাত্র-ছাত্রী ছয়জন। তবে পাঁচজনই নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসে না। একটি সূত্র জানায়, শহর থেকে কোনো কর্মকর্তা পরিদর্শনে এলে বিদ্যালয়ে পিকনিকের আয়োজন করা হয়। তখন বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক উপস্থিতি দেখা যায়। বন্দরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী খাদিজা আক্তার জানায়, তার শ্রেণিতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছয়জন। তিনজন প্রতিদিন, তিনজন মাঝেমধ্যে বিদ্যালয়ে আসে। চতুর্থ শ্রেণির সুমাইয়া আক্তার ও রুমানা আক্তার জানায়, তাদের ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী সাতজন। সূত্র মতে, বিদ্যালয়ে শিক্ষিকার সংখ্যা চার। প্রধান শিক্ষক জয়গুন বেগম বিদ্যালয়ে মাঝেমধ্যে আসেন।

নতুন সরকারি হওয়া দেওগাঁও রজনীগন্ধা, ভেলাজান, পশ্চিম বাগুলাডাঙ্গী পিপি, বাগুলাডাঙ্গী, মহব্বতপুর সাজগাঁও, আরাজি পাহাড়ভাঙ্গা আদর্শ, আখানগর বয়তালপাড়া সরকারি বিদ্যালয়গুলোর এমন চিত্র মাসের প্রায় প্রতিদিনের।

সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা লিয়াকত আলী সরকার জানান, সর্বশেষ গেজেটভুক্ত ১০টি বিদ্যালয়ের তথ্য জেলা যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানো হয়েছে এবং বিদ্যালয়গুলো নিবিড় তত্ত্বাবধানে রয়েছে। কোনো অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ এম শাহজাহান সিদ্দিক বলেন, ‘এটি নতুন কিছু নয়, এটি রোধ করা কঠিন ব্যাপার। কারণ এই প্রক্রিয়ায় জনপ্রতিনিধিরাও জড়িত। জনপ্রতিনিধিদের সুপারিশ ও সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী এসব বিদ্যালয় সরকারীকরণ হয়েছে। তাই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীসংখ্যা ও উপস্থিতি বাড়ানোসহ শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার পাঁচ উপজেলায় ৪১৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। ২০১৩ সালে সরকার সারা দেশের রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা দিলে ঠাকুরগাঁওয়ে প্রথম ধাপে ৪৮৯টি, দ্বিতীয় ধাপে ৪৭টি ও সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ তৃতীয় ধাপে ২৬টি বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয়।

শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032849311828613